ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

লাশ টানতে টানতে নজরুল এখন ‘লাশ নজরুল’

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৭
লাশ টানতে টানতে নজরুল এখন ‘লাশ নজরুল’ নজরুল ইসলাম ছবি: বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: নব্বইয়ের দশকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় কেউ না কেউ লাশ (মরদেহ) হত।  সেই মরদেহ টানার জন্য সীতাকুণ্ড থানা থেকে ডাক পড়ত টেম্পু চালকদের।  অধিকাংশ টেম্পু চালক তখন পুলিশ দেখলেই পালিয়ে যেতেন।  

তবে পালাতেন না একজন।   তিনি সীতাকুণ্ড পৌরসভার শেখপাড়ার গোলাম রহমানের ছেলে নজরুল ইসলাম।

  পরিচিত-অপরিচিত, বেওয়ারিশ সব ধরনের মরদেহ নিজের টেম্পুতে তুলে পৌঁছে দিতেন মর্গে।   সেই থেকে শুরু।
  টেম্পু চালানো ছেড়ে মরদেহ টানাই এখন নজরুল ইসলামের পেশা।

২৭ বছর ধরে লাশ টানতে টানতে তার নামের আগেও যুক্ত হয়ে গেছে ‘লাশ’ শব্দটি।   আর সীতাকুণ্ডে এখন শুধু দুর্ঘটনা নয়, খুন, আত্মহত্যাসহ অস্বাভাবিক সব মৃত্যুর ঘটনার পরই থানা থেকে ডাক আসে, ‘লাশ নজরুল, তুমি কোথায় ?’

সম্প্রতি সীতাকুণ্ড পৌরসভার প্রেমতলায় ছায়ানীড় ভবনে বোমা বিস্ফোরণে নিহত চার জঙ্গিসহ পাঁচজনের মরদেহও উদ্ধার করেছেন নজরুল।   সেখানেই কথা হয় নজরুলের সঙ্গে।

পঞ্চাশোর্ধ নজরুল বাংলানিউজকে বলেন, ৯১ সালে টেম্পু চালানো ছেড়ে দিয়েছি।   তখন থেকে লাশ টানাই আমার পেশা।   থানার আশেপাশে থাকি।   কোথাও অ্যাকসিডেন্ট, খুন কিংবা বেওয়ারিশ লাশের খবর পেলেই থানা থেকে ওসি স্যার ফোন করে বলেন, লাশ নজরুল তুমি কোথায় ? তখন আমি থানায় ঢুকি।

তিনি বলেন, এখন তো হাইওয়েতে অ্যাকসিডেন্ট অনেক কমে গেছে।   আগে বেশি ছিল।   শুরুতে কম টাকা দিত।   ৫০-১০০ টাকা দিত।   কয়েক বছর আগে একজন ওসি স্যার সীতাকুণ্ড থানায় এসেছিলেন।   তিনি বললেন, লাশ নজরুলকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া থেকে পুরো কন্ট্রাক্ট দিয়ে ‍দাও।   তখন থেকে চার হাজার টাকা করে পাচ্ছি।   একবার লাশ উদ্ধার করলে এখন ৫০০ টাকার মতো থাকে।

বেওয়ারিশের চেয়ে পরিচয় পাওয়া মরদেহ টানতেই আগ্রহ বেশি নজরুলের।   বলেন, বেওয়ারিশ লাশ টানলে তেমন টাকা থাকে না।   আত্মীয়স্বজন পাওয়া গেলে তাদের কাছ থেকে টাকাপয়সা চেয়ে নিতে পারি।

সীতাকুণ্ড থানার ওসি ইফতেখার হাসান বাংলানিউজকে বলেন, সীতাকুণ্ড থানায় প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন ঘটনা থাকে।   দুর্ঘটনা থাকে।   লাশ উদ্ধার করতে হয়।   আমাদের কাজে নজরুল অনেক সহযোগিতা করে।

২০১১ সালে মিরসরাইয়ের আবু তোরাবে স্কুল ছাত্রদের নিয়ে একটি মিনি ট্রাক খাদে পড়ে স্মরণকালের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।   মারা যায় ৪০ জনেরও বেশি স্কুলছাত্র।   এই মরদেহ টানার জন্যও ডাক পড়েছিল নজরুলের।

সেদিনের লাশ টানার স্ম‍ৃতি এখনও আবেগপ্রবণ করে নজরুলকে, ‘চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই।   মাসুম বাচ্চাগুলো।   নিজের ছেলের কথা মনে পড়েছিল।   একেকজনের লাশ নিয়ে যখন তাদের মা-বাবার হাতে দিচ্ছিলাম, হায়রে জীবন !’
১২ বছর আগে সীতাকুণ্ডের আনোয়ারা জুট মিলের সামনে বাস দুর্ঘটনায় ২৩ জন মারা যায়।   সেই ২৩ জনের মরদেহ টানার স্মৃতিও এখনও ভুলতে পারেননি নজরুল।  
তবে ছায়ানীড় ভবনের জঙ্গি আস্তানা থেকে পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধারের পর নজরুলের মনে হচ্ছে, এরকম বিভৎস ঘটনা ২৭ বছরের লাশ টানার জীবনে নজরুল আর দেখেননি।  

‘শিশুটার কী দোষ ছিল।   সে মরে পড়ে থাকল মায়ের পাশে।   একজনের মাথা আছে দেহ নাই।   একজনের হাত উড়ে গেছে আরেক বিল্ডিংয়ে।   এগুলো নাকি ধর্মের জন্য।   ধর্ম কি এসব কথা বলেছে ?’ বলেন নজরুল

বংশের মধ্যে নজরুল একজনই, যে মরদেহ টানাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।   এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে সবসময় প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছে তাকে।   তার স্ত্রী সবসময় কান্নাকাটি করে।   একবার রাগ করে তিন সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলেন বলেও জানান নজরুল।  

তিনি বলেন, ঘরে বৌ বেশি ডিস্টার্ব করে।   আমার ভাইয়েরা, ছেলেরা বলে এই পেশা ছেড়ে দাও।   আত্মীয়স্বজন ঘৃণা করে।   একবার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল।   ১৬ দিন নিখোঁজ ছিলাম।   কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি।   তখন থানা থেকে খোঁজাখুঁজি পড়ে গিয়েছিল।   পুলিশ আমাকে খুঁজে পেতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযানও চালিয়েছিল।  
‘আমি আমাদের মাদ্রাসার বড় হুজুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার পেশা খারাপ কি না।   উনি আমাকে বলেছেন আপনি যে কাজ করছেন এটা ভাল কাজ।   কাজ সবসময় ইবাদত।   এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যদি শরীর ভাল থাকে লাশ টেনেই যাব। ’

মরদেহ টানার আয় দিয়েই নজরুল গত বছর তার এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।   বিয়েতে নজরুলের পেশা নিয়ে শ্বশুরপক্ষ একটু আপত্তি তুলেছিল।   কিন্তু মাদ্রাসার বড় হুজুর আর সীতাকুণ্ড থানার ওসি তাদের বুঝিয়ে রাজি করান বলে জানান নজরুল।
এক ছেলে সীতাকুণ্ড ডিগ্রি কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র।   ছোট মেয়ে স্থানীয় মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী।

‘ছেলে বলে বাবা, আমাকে সবাই লাশ নজরুলের ছেলে বলে।   তুমি এই কাজ ছেড়ে দাও।   আমি বলি, বাবা তুমি এই কাজের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করছ।   ভাত খাচ্ছ।   এই কাজকে ছোট করে দেখো না। ’ বলেন নজরুল

তবে এই লাশ টানার পেশায় কাউকে আর নিজের ‘সাগরেদ’ করার ইচ্ছা নেই বলে জানালেন নজরুল।

‘ইনকাম নাই, ভাত খেতে পারে না।   আমার সঙ্গে কাজে লাগাইলাম।   পুলিশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।   পরে দেখলাম, পুলিশের সোর্স হয়ে গেছে।   তখন আর লাশ টানে না।   তাদের সাগরেদ বানাইয়া আমার লাভ কি।   জীবনের শেষদিন পর্যন্ত একাই লাশ টানব। ’

২৭ বছর ধরে এত লাশ টানছেন, কার লাশ তার কাছে সবচেয়ে ভারি মনে হয়েছে এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ‍আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন নজরুল।   চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে অশ্রু।   এক কথায় জবাব দেন, আব্বার লাশ।

নজরুলের পিতা গোলাম রহমান ৮০ বছর বয়সে মারা গেছেন ১১ বছর আগে।   মা এখনও জীবিত আছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪২ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৭
আরডিজি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।