শ্রমিকরা অস্ত্র খালাসে অপারগতা জানালে পাক সেনারা তাদের বুকেই গুলি চালিয়ে দেয়।
সোয়াত জাহাজে করে অস্ত্র আসার খবর ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রামের সর্বস্তরে।
মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর আগেই ২৪ মার্চ সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাস প্রতিরোধের সেই দিনটি ব্যাপক আকারে ‘বাঙালির জনযুদ্ধ’ হিসেবে স্থান পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, যুদ্ধ বলতে যেটা আমরা বুঝি সেটা চট্টগ্রামে শুরু হয়েছিল ৩ মার্চ ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে। ২৪ মার্চ সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধের জন্য যে রক্তস্নাত আন্দোলন হয়েছিল সেটা জনযুদ্ধে ব্যাপকতা দেয়। কারণ এই আন্দোলনে শ্রমিক, ছাত্র, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সাধারণ জনতা সবাই ছিলেন।
‘আর চট্টগ্রামে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে ২৫ মার্চ রাতে। সেদিন ক্যাপ্টেন রফিক হালিশহরে ইপিআরের ক্যাম্প দখল করে প্রায় ১৫০ জন অবাঙালি সৈন্য হত্যা করেন। ’
ইতিহাসের আরও একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের কথা জানালেন মাহফুজুর রহমান।
সোয়াত জাহাজে অস্ত্র খালাসে অস্বীকৃতি জানালে চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকদের উপর চড়াও হয় পাকিস্তানি সেনারা। বিভিন্নভাবে চাপ দিয়ে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে প্রায় ১৫০ শ্রমিককে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে খুন করা হয় বলে জানান মাহফুজুর রহমান।
‘এই ঘটনার পর শ্রমিকরাও সেসময় চলা উত্তাল অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। একটা জনযুদ্ধের জন্য এটা একটা বড় ঘটনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে সত্যিকারের জনযুদ্ধ ছিল এটা তার বড় প্রমাণ। ’ বলেন মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানী
‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, বন্দরের এক ক্ষুব্ধ ডক শ্রমিক সোয়াত জাহাজ থেকে ২৪ মার্চ অস্ত্র খালাস হবে বলে এমন তথ্য পৌঁছে দেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের কাছে। তিনি বিষয়টি ঢাকায় আওয়ামী লীগের নেতাদের জানালে তারা বলেনম কোনভাবেই সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস ও সৈন্য নামতে দেয়া যাবে না।
চট্টগ্রামের তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরী, মজিদ মিয়া, ইসহাক মিয়া, আতাউর রহমান খান কায়সার, আবদুল্লাহ আল হারুন, আবু সালেহ, এস এম জামালউদ্দিন, মোহাম্মদ হারিছ মিয়া সভা-সমাবেশে সোয়াত জাহাজে করে অস্ত্র আনার বিষয়টি তুলে ধরে জনতাকে প্রতিরোধের আহ্বান জানান।
২৪ মার্চ বিকেল ৪টায় সোয়াত জাহাজ অবরোধের ডাক দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কলোনির মাঠে সমাবেশ ডাকা হয়।
‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, সেদিন সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধের সমাবেশ আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা শামসুদ্দিন, চট্টগ্রাম বন্দরের জুনিয়র ক্লার্ক আ ক ম রইসুল হক বাহার, তরুণ ছাত্র আব্দুস সাত্তার ও তারেক। সেই সমাবেশে শুধু ছাত্র-তরুণই নয়, বন্দরের শ্রমিক এবং নিউমুরিং কলোনিসহ আশপাশের এলাকার সাধারণ বাসিন্দারাও যোগ দেন। বিশাল সমাবেশ এক পর্যায়ে প্রতিবাদি জনসভায় রূপ নেয়।
সন্ধ্যার দিকে সমাবেশস্থলে খবর আসে অস্ত্র খালাসের জন্য সোয়াত জাহাজ জেটিতে ভিড়েছে। সমাবেশ থেকে ৪-৫ হাজার মানুষ স্টিলের রড নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের তিন নম্বর জেটি অভিমুখে মিছিল শুরু করে। চকবাজারের প্যারেড গ্রাউন্ডে সেদিন মঞ্চস্থ হচ্ছিল নাটক ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাদের কাছে খবর পৌঁছার পর জনতা নাটক দেখা বন্ধ করে বন্দরের দিকে রওনা দেয়। বন্দর থেকে ডক শ্রমিকরাও বেরিয়ে আসে।
আগ্রাবাদের বারিক বিল্ডিং মোড়ে নেভি ফিট ক্লাবে ছিল বন্দর জোনের নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ সেন্টার। নেভি ফিট ক্লাব ঘেরাও করে রাখা ছিল মিছিলের উদ্দেশ্য। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে মিছিল যখন বন্দরের তিন নম্বর জেটি গেটের কাছে পৌঁছে, তখন পাকবাহিনী রাস্তা অবরোধ করে গুলি চালায়। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। গভীর রাত ১টা পর্যন্ত সেদিন ওই এলাকায় গুলির শব্দ শোনেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ডা. মাহফুজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধ করতে গিয়ে অনেকেই শহীদ হন। সঠিক সংখ্যা সেভাবে জানা যায়নি। তবে ৪-৫ জনেরও বেশি হতে পারে।
‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে আ ক ম রইসুল হক বাহারের তথ্যে নিহতের সংখ্যা তিনজন উল্লেখ আছে। বাহার পরদিন পত্রিকায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনের বিবৃতির প্রসঙ্গ টেনে এই তথ্য দিয়েছেন।
তবে ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থের ২৬৯ পৃষ্ঠায় ২৩ জন নিহতের তথ্য উল্লেখ আছে।
আ ক ম রইসুল হক বাহার চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন, পরবর্তী জীবনে যিনি জড়িয়েছেন সাংবাদিকতায়। বন্দরে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি নথিপত্র ঘেঁটে পাকিস্তানের অস্ত্রবোঝাই সেই জাহাজটির নাম স্বাধীনতার পরে জেনেছিলেন। তবে বন্দরের নথিপত্রে উল্লেখ নেই, সেই জাহাজে কী পরিমাণ অস্ত্র ছিল কিংবা কি কি অস্ত্র ছিল। সেই অস্ত্র খালাস হয়েছিল কি-না সেটাও বন্দরের নথিপত্র ঘেঁটে জানতে পারেননি রইসুল হক বাহার।
তবে সেই অস্ত্র খালাস প্রতিরোধ আন্দোলনের আরেক অগ্রসেনানী নুর মোহাম্মদ ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে তথ্য দিয়েছেন, ২৪ মার্চ রাতে কিছু অস্ত্র খালাস করা হয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে সোয়াত জাহাজের সব অস্ত্রই খালাস করা হয়। ২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরুর পর তিনি নিজের চোখে ট্রেনে করে অস্ত্র নিয়ে যেতে দেখেন।
ডা. মাহফুজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কয়জন মারা গেছে, অস্ত্র খালাস হয়েছিল কি না, এর চেয়েও বড় ঘটনা হচ্ছে সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরুর আগে বাঙালিদের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের বড় আকারের প্রতিরোধ। সেই ঘটনা মানুষের মাঝে জাগরণ সৃষ্টি করেছিল।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৭
আরডিজি/টিসি