অনানুষ্ঠাকিভাবে ‘থানচি বিদ্যুতায়ন প্রকল্প’ চালু হলেও আগামী ১ মার্চ সকাল ১১টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই নতুন বিদ্যুতায়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর আগে রোববার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রামের উদ্যোগে নতুন এই বিদ্যুতায়ন প্রকল্প দেখানোর জন্য থানচি উপজেলায় পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, কোথাও উঁচু কোথাও নিচু থানচি যাওয়ার এই সড়কের কোনো কোনো জায়গা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৯০০ ফুট উপরে। সেই সড়কের পাশ ধরেই চিম্বুক থেকে থানচি পর্যন্ত চলে গেছে বিদ্যুতের ১২৯৮টি খুঁটি।
বান্দরবান থেকে ওয়াই জংশন পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এবং ওয়াই জংশন থেকে চিম্বুক পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার পথ পর্যন্ত আগে থেকেই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল। থানচি বিদ্যুতায়ন প্রকল্পের অধীনে চিম্বুক থেকে বলিপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ ৩৩ কেভি এবং বলিপাড়া থেকে থানচি বাজার পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ ১১ কেভি নতুন লাইন স্থাপন করা হয়েছে।
পিডিবি সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল অনুমোদন পাওয়ার পর প্রায় ২৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ধাপে-ধাপে কাজ করার পর প্রায় ১৪ মাসের মাথায় ২০১৬ সালের ৩০ জুন এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। আরও কিছু কিছু ছোটখাটো স্থাপন কাজ বাকি থাকায় এর দুই মাসের মাথায় বিদ্যুৎ পায় উপজেলার বাসিন্দারা।
থানচি উপজেলার কিছু কিছু মানুষের ঘরে আগেও বাতি জ্বলত। তবে তা সৌরবিদ্যুৎ থেকে। সোলারের মূল্য অনেক বেশি হওয়ায় এই অঞ্চলের গরিব মানুষদের পক্ষে এটা কেনা সম্ভবও ছিল না। বিদ্যুৎ আসায় ইতিমধ্যে প্রায় চারশটি সংযোগ (মিটার) দেওয়া হয়েছে। আরও অনেকেই সংযোগের জন্য আবেদন করেছেন।
বলিপাড়া এলাকায় বসানো হয়েছে একটি সাবস্টেশন। সেখানে কথা হয় স্থানীয় যুবক উশৈনু মারমার সঙ্গে।
উশৈনু বাংলানিউজকে বলেন, ‘কয়েকবছর আগেও বিদ্যুৎ পাবো-এটা আমাদের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এখন সেটা আর স্বপ্ন না, বাস্তবে পরিণত হয়েছে। আমরা এখন আর অন্ধকারে নেই। কারও কারও বাড়িতে সোলার থাকলেও তা সবসময় চালানো যেত না। এখন প্রায় সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আছে। রঙিন টিভি দেখতে পারছি, যখন তখন ফ্যান চালাতে পারছি। সবকিছু মিলে আমাদের পৃথিবীটা বদলে গেল। ’
হেসে হেসে একটা সুন্দর উদাহরণও দিলেন উশৈনু।
বলেন ‘পাহাড়ে একেক জায়গায় একেকটি বাড়ি। বিদ্যুৎ আসার পর এখন এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে তাকালে মনে হয় পাহাড়টা আকাশ, আর বাতিগুলো এক একটা তারা। ’
পরিদর্শনকালে সঙ্গে থাকা পিডিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিচালন ও সংরক্ষণ সার্কেল, রাঙামাটি) মো. দুলাল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, দু’বছর আগেও এই অঞ্চলের মানুষের কাছে বিদ্যুৎ স্বপ্ন ছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগের ফলে এই দুর্গম অঞ্চলের মানুষও বিদ্যুৎ পেল। তবে কাজটা সহজ ছিল না। আমাদের সবার পরিশ্রম, ত্যাগ ও থানচি উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের সবার একাগ্রতায় এটা সম্ভব হয়েছে। ’
বান্দরবান থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পাহাড়ি উঁচু-নিচু দুর্গম পাহাড়ি পথ পেরিয়ে বিকেল তিনটার দিকে যখন থানচি বাজারে পৌঁছে দেখা গেল, সবকিছু যেন অন্যান্য উপজেলা শহরের মতোই ঠিকঠাক। ফ্যান চলছে, সবাই ব্যস্ত রঙিন টিভি দেখতে। সঙ্গে ফটোকপি-প্রিন্ট করার যন্ত্রপাতিও আছে সেখানে। বিদ্যুৎ আসার পর বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বিক্রির বিভিন্ন দোকানও গড়ে উঠেছে সাঙ্গু নদীর পাড়ের এই বাজারে।
সেখানে লাইট হাউস নামে একটি ফটোকপি ও প্রিন্টের দোকানে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন দোকানের মালিক ক্লাদিং কুমি।
বিদ্যুৎ আসার পরের সুবিধা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ক্লাদিং কুমি এক নাগাড়ে বলতে লাগলেন, ‘বিদ্যুৎ আসায় আমার ব্যবসা জমজমাট হয়েছে। আগে ফটোকপির মেশিন সবসময় চালাতে পারতাম না। জেনারেটর বন্ধ করে দেওয়ায় রাত দশটার মধ্যেই দোকান বন্ধ করে ফেলতে হতো। পাশাপাশি একটা বাতি জ্বালানোর জন্য প্রতি মাসে দুইশ-তিনশ টাকা দিতে হতো। এখন বিদ্যুৎ আসায় লাইট-ফ্যান সহ ফটোকপি-প্রিন্ট মেশিন চালানোর জন্যও অত টাকা দিতে হচ্ছে না। ’
উপজেলা চেয়ারম্যান ক্যহ্লাচিং মারমা বলেন, আগে আমার উপজেলাকে দুর্গম বলতো সবাই। তবে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়ায় একে আর দুর্গম বলা যাবে না। বান্দরবান থেকে থানচিতে দিনে এসে দিনে যাওয়া যায় এখন। বিদ্যুৎ চলে আসায় নাগরিক সুবিধার ষোলকলা পূর্ণ হলো এখন।
তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমার উপজেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। এতে করে এই এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নতি ঘটছে। ’
পিডিবির উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান ভূঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, বিদ্যুতায়নের ফলে পিছিয়ে পড়া থানচি উপজেলার মানুষের জীবনমান উন্নত হবে। উপকেন্দ্র নির্মাণের ফলে ভোল্টেজ সমস্যারও সমাধান হবে। এছাড়া বিদ্যুতায়নের ফলে এই এলাকায় পর্যটন শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটবে। পাশাপাশি আগে গুদামের অভাবে ফলমূল সংরক্ষণ করা যেত না। কিন্তু এখন বিদ্যুতায়নের ফলে গুদাম গড়ে তুলতে আর বাধা রইল না।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৭
টিএইচ/আইএসএ/টিসি