ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পোড়ামাটির শিল্পকর্মে লেখা হলো ‘ইতিহাস’

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
পোড়ামাটির শিল্পকর্মে লেখা হলো ‘ইতিহাস’ পোড়ামাটির (টেরাকোটা) শিল্পকর্মে লেখা হলো ‘ইতিহাস’ পড়তে ভিড় করেন নানা বয়সী মানুষ। ছবি: উজ্জ্বল ধর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: বীরের দেশ চট্টগ্রাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে এ জনপদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আর তাই ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দেয়ালে পোড়ামাটির (টেরাকোটা) শিল্পকর্মে লেখা হলো ‘ইতিহাস’।

নগরীর জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের উদ্যোগে শিল্পকর্মটি করেছেন ভাস্কর প্রণব সরকার ও অরবিস আরকিটেকচারাল কনসালটেন্টের স্থপতি আইনুল ইসলাম শাওন। এ কাজে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক ‘আজাদী’।

খরচ হয়েছে প্রায় ১২ লাখ টাকা।

মাত্র ১৮ দিনে পোড়ামাটির শিল্পকর্মটি গাজীপুরের একটি কারখানায় তৈরি করেছেন ভাস্কর প্রণব কুমার সরকার।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এ সাবেক ছাত্র বর্তমানে বিএএফ শাহিন কলেজের চারুকলার শিক্ষক।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ভাস্কর্যের একটি ভাগ হচ্ছে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম। ৫৭০ বর্গফুটের এ শিল্পকর্মটি আমি যেমনটি চেয়েছি অবিকল তেমন হয়েছে। কারণ পোড়ামাটির শিল্পকর্মে অনেক সময় প্রত্যাশিত অবয়ব আসে না। তাই আমি ফিনিশিং কাজের চেয়ে আমি রাফ কাজকেই গুরুত্ব দিয়েছি।

উদ্বোধন শেষে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম ঘুরে দেখেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন

তবে শিল্পকর্মটিকে ‘ইতিহাস’ বলতে নারাজ ভাস্কর প্রণব। তিনি বলেন, এ শিল্পকর্ম দেখে শিশু-কিশোররা, ছাত্রছাত্রীরা, পথচারীরা জানতে চেষ্টা করবে মাস্টারদা সূর্য সেন কে ছিলেন, প্রীতিলতা কে, ক্ষুদিরাম বসুর অবদান কী ইত্যাদি। তারা জানতে চেষ্টা করবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি জেনারেলের আত্মসমর্পণ ইত্যাদি সম্পর্কে। এককথায় নবীনদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করবে।  

সরেজমিন দেখা গেছে, মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকালে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন উদ্বোধনের পর থেকেই শিল্পকর্মটি দেখতে ভিড় করেন নানা বয়সী মানুষ। বঙ্গবন্ধু, মাস্টারদার ভাস্কর্যের সামনে সেলফি তোলার হিড়িক পড়ে। সন্ধ্যায় আলো ঝলমলে হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।

প্রথম শিল্পকর্মে রয়েছে ‘ব্রিটিশ বিপ্লবের মহানায়ক’ মাস্টারদা সূর্য সেন, বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ক্ষুদিরাম বসুসহ সহযোদ্ধাদের প্রতিকৃতি। দ্বিতীয় শিল্পকর্মে ব্রিটিশবিরোধী সিপাহি জনতা বিদ্রোহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তৃতীয় শিল্পকর্মে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলন তথা বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে গুলির চিত্র। পরের শিল্পকর্মে ছয় দফা আন্দোলন। পঞ্চমে সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর সেই অগ্নঝরা ভাষণ। এটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে। বিশেষ করে পুরুত্ব বেশি।

পরের শিল্পকর্মে চিত্রিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। পরেরটিতে ‘বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা বাঙ্গালী জাতি’। অষ্টম শিল্পকর্ম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধিনায়কের আত্মসমর্পণ। ফটকের ডানপাশে আছে তিনটি শিল্পকর্ম। এর মধ্যে রয়েছে সাত বীরশ্রেষ্ঠ, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, ‘স্বাধীন বাংলার মুক্ত সন্তানেরা শাপলা তুলছে সরোবরে’ এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা।   

সন্ধ্যায় বাকলিয়া থেকে সপরিবারে পোড়ামাটির শিল্পকর্মে ইতিহাস দেখতে এসেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আবুল কালাম। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে টেম্পুতে আগ্রাবাদের কর্মস্থলে যাওয়া-আসার সময় এখানে ঘেরাও দিয়ে কিছু একটা হচ্ছিল দেখতাম। আজ শুনেছি পোড়ামাটিতে ইতিহাস চিত্রিত হয়েছে। তাই সপরিবারে ছুটে এলাম। উদ্বোধনের পর থেকে অনেকেই জামালখানে ছুটে আসেন পোড়ামাটির শিল্পকর্মে ইতিহাস দেখতে

তিনি বলেন, এককথায় এ শিল্পকর্মটি চট্টগ্রামকে ভিন্ন মাত্রা দেবে। স্বাধীনতার এত বছর হলো এ ধরনের একটি শিল্পকর্ম তৈরির কথা কেউ ভাবল না সেটি ভাবতেই অবাক হচ্ছি। এভাবে প্রতিটি ওয়ার্ডে যদি কিছু কিছু কাজ হতো তবে পুরো চট্টগ্রামই পর্যটন তীর্থে পরিণত হতো।  

চারুকলার একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, পোড়ামাটির শিল্পকর্ম অনেক কঠিন কাজ। এটি সময়সাপেক্ষ এবং ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকি হচ্ছে প্রত্যাশিত অবয়ব দেওয়া নিয়ে। এক দেয়ালে ইতিহাস বলার যে চেষ্টা তা নিঃসন্দেহে অভিনব। তবে আরও গভীরভাবে শিল্পকর্মগুলো নির্বাচন করা যেত। বিশেষ করে ভাষাশহীদদের প্রতিকৃতিগুলো পষ্টভাবে থাকলে শিশু-কিশোরদের জন্য সুবিধা হতো।   

গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়কারী শরীফ চৌহান গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন ভাস্কর্যগুলো। অনুভূতি জানতে চাইলে বাংলানিউজকে বললেন, ‘একটি দেয়ালে শতবর্ষের ইতিহাস তুলে ধরার এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। চট্টগ্রামে পোড়ামাটির এত বড় শিল্পকর্ম আর নেই। এ পথে প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা চলাফেরা করেন। তাদের ইতিহাস জানতে আগ্রহী করবে শিল্পকর্মটি। ’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, একেবারে নবীন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে প্রতিটি শিল্পকর্মের নিচে বা উপরে যদি আলাদাভাবে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বা পরিচিতি দেওয়া যায় তবে ভালো হতো।

এ প্রসঙ্গে কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন বাংলানিউজকে বলেন, একটি শিল্পকর্মে দেখা গেল অনেক প্রতিকৃতি রয়েছে, কিন্তু নাম দেওয়া হয়েছে তিনজনের। এক্ষেত্রে আলাদাভাবে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি বা ছোট্ট ইতিহাস দেওয়ার যে প্রস্তাব এসেছে তা বিবেচনা করা হবে।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে দুজন প্রহরী দিচ্ছি। যারা শিল্পকর্মে যাতে কেউ হাত না দেন, ফুলগাছের ফুল যেন কেউ না ছিঁড়েন এসব দেখভাল করবে। তবে এ শিল্পকর্মের সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের এবং প্রশাসনের। কারণ এটি এখন চট্টগ্রামবাসীর গর্বের জায়গায় পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭

এআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।