ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘ব্লক করো, কেউ যাতে বের হতে না পারে’

সুবল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৭
‘ব্লক করো, কেউ যাতে বের হতে না পারে’ ভূমি প্রতিমন্ত্রী মো. সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের সারপ্রাইজ ভিজিট। ছবি: সোহেল সরওয়ার, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেই অফিসের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন, ‘এ পর্যন্ত ব্লক করো, এলএ শাখা থেকে কেউ যাতে বের হতে না পারে।’

রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখায় ঢুকতেই পুলিশকে এ নির্দেশ দেন ভূমি প্রতিমন্ত্রী মো. সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ।
 
নির্দেশনা অনুসারে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা এলএ শাখার অফিস থেকে ভূমি প্রতিমন্ত্রী সারপ্রাইজ ভিজিটে থাকাকালীন প্রায় ২ ঘণ্টা আর কাউকে বের হতে দেয়নি।
ভূমি প্রতিমন্ত্রী এলএ শাখার অফিসে ঢুকতেই মোহাম্মদ রফিক নামে ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধকে ডেকে বলেন ‘এখানে কেন আসলেন। ’ উত্তরে তিনি বলে উঠলেন ‘এমনি আসছি।
’ তখনই ভূমি প্রতিমন্ত্রীর সন্দেহ হলো-‘ওনি দালাল’। কেননা, কাজ না থাকলে এল‌এ শাখায় আসার তো কথা নয়।
 
তখন ওই ষাটোর্ধ মোহাম্মদ রফিকের হাতে থাকা ব্যাগ চেক করে দুটি ডায়েরি পান। ডায়েরিতে বিভিন্ন জায়গার খতিয়ান ও দলিলের নম্বর পাওয়া যায়। তখনই তার সন্দেহের সত্যতা পাওয়া যায়। তাকে আবারও প্রতিমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন ‘আপনার কোনো কাজ না থাকলে এখানে কেন আসলেন? আপনি তো দালাল’।
 
উত্তরে রফিক বলে উঠলেন ‘আমি করিমের কাছে এসেছি এমনি। ’ তখনই প্রতিমন্ত্রী তাকে ‘দালাল’ সম্বোধন করে পুলিশের হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত ভূমি অফিসে দালালি করার অপরাধে মোহাম্মদ রফিককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে ছেড়ে দেয়।
 
পরবর্তীতে এলএ শাখার বিভিন্ন কক্ষে ভূমি প্রতিমন্ত্রী ফাইল তলব করতে থাকে। মোহাম্মদ সায়েম নামের এক কর্মচারীর কাছে মিস মামলার কী অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে, সায়েম কয়েকটি ফাইল প্রতিমন্ত্রীকে খুলে দেখান। এসময় ওই কক্ষে সকল কর্মচারীকে উদ্দেশ করে বলে ওঠেন ‘এলএ শাখার বিরুদ্ধে আমার কাছে অনেক অভিযোগ রয়েছে। এখানে সাধারণ মানুষ খুব বেশি হয়রানি হচ্ছে। ’
 
তখন মোবারক উল্লাহ নামে সেবা নিতে আসা এক ব্যক্তি প্রতিমন্ত্রীকে বলেন ‘স্যার, গত আড়াই বছর থেকে ভূমি অধিগ্রহণের কাজে এলএ শাখায় আমার আসা-যাওয়া। ইতোমধ্যে আমার নিজস্ব জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু গত আড়াই বছরে আমি এক টাকাও পাইনি। তবে গত সপ্তাহে একটি চেক পেয়েছি। কিন্তু নানা জটিলতায় এখনও টাকা তুলতে পারিনি। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এখান থেকে নাকি ১৫ শতাংশ টাকা এলএ শাখায় কেটে নেবে। ’ভূমি প্রতিমন্ত্রী মো. সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের সারপ্রাইজ ভিজিট
 
তখন ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোবারক উল্লাহকে বলেন ‘কাউকে কোনো টাকার ভাগ দেবেন না। সরকারি ফি ব্যতীত কোনো টাকা দেবেন না। আপনাকে আড়াই বছর কে কে হয়রানি করেছে?’ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ‘এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে গেলেই টাকা দিতে হয়। ইতেমধ্যে প্রায় ১০০, ২০০, ৫০০ টাকা করে প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা দিয়েছি। টাকা দিলেও নির্ধারিত সময়ে কখনো এলএ শাখায় কাজ হয় না।
 
একইভাবে সেবা নিতে আসা মনছুর আলী, নজির আহমদ, শামসুল আলমসহ আরও বেশ কয়েকজন ভূমি প্রতিমন্ত্রীকে এলএ শাখার দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন। ভুক্তভোগীরা বলেন, ‘এলএল শাখায় কর্মরত করিম, হান্নান, নজরুল, সৈকত চাকমা, মোবারক আলীসহ আরও কয়েকজন মিলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষদের নানাভাবে হয়রানি করছে। জমি অধিগ্রহণের চেক নিয়ে নানা প্রতারণা করছে। এমনকি অফিসের চেইনম্যান ও সার্ভেয়ারেরা চিহ্নিত করিম, হান্নান, ইলিয়াছ এসব দালালদের মাধ্যমে একজন আরেকজনকে দিয়ে মামলা-মোকদ্দমা এবং হাইকোর্টে রিট দায়েরের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের সেবা পেতে দিচ্ছে না। তারা নানাভাবে হয়রানি করছে।
 
পরবর্তীতে, অভিযুক্ত চেইনম্যান ও সার্ভেয়ারদের এলএ শাখা প্রধানের কক্ষে ডেকে পাঠান ভূমি প্রতিমন্ত্রী। যদিও অভিযুক্তরা কেউ ভূমি প্রতিমন্ত্রীর সামনে আসেনি। প্রতিমন্ত্রী তারা কোথায় জানতে চাইলে, সবাই সার্কিট হাউজের উন্নয়ন সভায় দায়িত্ব পালন করার কথা জানান এলএ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে সৈকত চাকমা নামের এক সার্ভেয়ার প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর মন্ত্রীর সামনে এসে হাজির হন। অভিযোগের সত্যতা যাচাই বাছাই করে তাকে সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
 
পরবর্তীতে অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভূমি প্রতিমন্ত্রী মো. সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ সাংবাদিকদের জানান, সরকারের নানা প্রকল্পের কারণে চট্টগ্রাম এগিয়ে যাচ্ছে। যেভাবে ভূমি অধিগ্রহণ হচ্ছে চট্টগ্রামে সেই পরিমাণ ভূমি অফিসে কর্মকর্তা নাই। অনেক সীমাবদ্ধতা ও সংকটের মধ্যে ভূমি অফিসে কাজ চলছে। পরিদর্শনে এসে জানলাম চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এলএ শাখায় ৪টি ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকতার মধ্যে একজনও কর্মরত নেই। তবে এ বিষয়ে আমি মন্ত্রণালয়ে অবহিত করেছি। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এলএ শাখার ৩ জন চেইনম্যানকে অনত্র বদলীর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং একজন দালালকে ধরে মোবাইল কোর্টে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
 
তিনি আরও জানান, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে কেউ থামাতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসারে সাধারণ মানুষ যাতে কোনোরূপ হয়রানি না হয়, সে লক্ষ্যে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ভূমি অফিসে কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারীকে অনিয়ম ও দুর্নীতি করতে দেওয়া হবে না। ভূমি অফিসে দালাল উৎখাতে কাজ চলছে। সাধারণ মানুষদের সেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে যেখানে ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, সেখানে গিয়ে গণশুনানি করা হবে বলেও জানান তিনি।
 
 
 
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৭
এসবি/টিসি     
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।