ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘আপনারা দাঁড়ান অপরাধীদের রক্ষা করার জন্য নয়’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৭
‘আপনারা দাঁড়ান অপরাধীদের রক্ষা করার জন্য নয়’ বক্তব্য দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ছবি: সোহেল সরওয়ার, বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: আদালতে আইনজীবীদের ভাংচুর নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা।  সরাসরি বিষয়টি উল্লেখ করে কথা না বললেও ক্ষুব্ধ মনোভাবের কথা বক্তব্যে প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।

বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) বিকেলে চট্টগ্রাম আদালতে এক অনুষ্ঠানে তিনি আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা একজন অপরাধীর পক্ষে দাঁড়ান, অপরাধীদের রক্ষা করার জন্য নয়।   আপনারা সেখানে দাঁড়ান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

 

‘যতদূর সে আদৌ অপরাধ করেছে কিনা, অপরাধ যদি করে থাকে তাহলে এর মাত্রা, তার কতটুকু আইনের প্রটেকশন পাওয়া উচিৎ।   এখানে টাকা বা কোনকিছুর বিনিময়ে এটা ছিল না।

  কিন্ত পরে এটা হয়ে গেল।  

চট্টগ্রামে নবনির্মিত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যের শুরুতেই তিনি আইনজীবীদের ভাংচুরের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।  

প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা বিচারকরা এক লাইনও আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া লিখতে পারব না।   আপনারাই আমাদের প্রাণ।   আপনারা যা করবেন, আপনাদের ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারব না।   আপনাদের যদি একটু বিচ্যুতি হয়, এটা আমাদের রক্তক্ষরণ হয়।   আমার তো এখন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। নতুন ভবন উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা

তিনি বলেন, গতকাল একটা ঘটনা ঘটেছে।   আমি ভারাক্রান্ত এবং মর্মাহত।   সিলেটের পর চট্টগ্রাম আদালতকে আমি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছি।   আমি চট্টগ্রামকে সবসময় ঢাকার উপরে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি।   অন্য জেলায় যদি গিয়ে যদি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলি তাহলে চট্টগ্রামে কথা বলি।  

‘কিন্তু সকালে যখন এয়ারপোর্টে এসে পত্রিকা পড়লাম, আমি যে খবর পড়লাম, আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম চট্টগ্রাম আদালতে এই ভবন উদ্বোধনের জন্য যাওয়া উচিৎ কি না।  এরপর আমি নিজেকে আবার প্রশ্ন করলাম, মান-অভিমানের চেয়ে সবচেয়ে বড় জিনিস, এটা যদি বিলম্বিত হই, তাহলে বিচার বিভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।   আমাকে বিচার বিভাগের স্বার্থে আসতে হল। ’

‘আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি, গতকাল এখানে যে একটা ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল।   আমি নিজেকে এতদিন গর্ববোধ করতাম যে আমি প্রথমে একজন আইনজীবী।   এরপর আমার পরিচয় হল বিচারক। ’ বলেন সিনহা।

তিনি বলেন, যে মহান আইন পেশা, এই বিচার বিভাগ কোনদিনই প্রবর্তন হতো না, যদি আপনারা আইনজীবী ‘কমন ল’ যেটা আছে সেটা যদি প্রবর্তন না করতেন।  সারা পৃথিবীতে আইনের শাসনের কথা বলা হচ্ছে। এটার অগ্রণী ভূমিকা হল বিজ্ঞ আইনজীবীদের।  

‘এই পৃথিবীতে যারা আজ পর্যন্ত যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে, জাতিসংঘের সনদ প্রতিষ্ঠা করেছে, হিউম্যান রাইটসের যে সনদগুলো করেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে প্রত্যেকেই ছিল আইনজীবী।   এমনকি আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, তারও আইনের ডিগ্রি ছিল। ’নতুন আদালত ভবন

‘একটা বলা হয়, আপনি আইনের পেশায় আছেন সেটা না, আপনি অধ্যাপনা করেন, রাজনীতি করেন, আপনি যদি বিচারক হন, আপনাকে আইনের প্রতি জ্ঞান থাকতে হবে।   ন্যায়বিচার, প্রত্যেকটা ফিল্ডে একটা ন্যায়বিচারের প্রশ্ন উঠে।  এই পৃথিবীতে যারা রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী আছেন, প্রত্যেকের ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে ল’ইয়ার। ’

তিনি আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, এটাকে বলা হয় পেশা।   কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা পেশা না।   মহান এই আইনজীবীরা যে আদর্শের প্রতি বিশ্বাস রেখে আপনারা এই পেশায় নিয়োজিত।   আপনাদের এই মহান পেশাকে, মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখবেন।   আপনারাই তো এই শাসনতন্ত্র, এই সংবিধান সবগুলোর ধারক-বাহক।   আপনারা যদি চুল পরিমাণ বিচ্যুত হন, তাহলে কে হাল ধরবে ?’

ভাংচুরের ঘটনায় বিচারকদের ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, কালকের যে ঘটনা আমি শুধু বিজ্ঞ আইনজীবীদের দায়ী করব না।   আপনাদেরও কিছু বিষয় আছে।   কারণ আপনারা হচ্ছেন কোর্টের ম্যানেজার, অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।  

‘আমি প্রায়ই শুনি বিশেষ করে হাই ভোল্টেজ মামলা যেগুলো, শুধু চট্টগ্রামে না।   ঢাকাতেও যেগুলো হয় প্রায়ই শোনা যায় যে, হট্টগোল হচ্ছে কোর্টের ভেতরে।   কিছু আছে ৫০ জন, ১০০ জন আইনজীবী দাঁড়িয়ে যান।   এটা ঢাকাতে হচ্ছে, চট্টগ্রামে হচ্ছে ইদানিং, সিলেটে হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে।   আপনারা এসে দেখেন আমরা কীরকম কন্ট্রোল করি।   এটা আপনাদের অপারগতা। ’

‘ আমি বিজ্ঞ আইনজীবীদের আকুল আবেদন করছি, আপনাদের আমরা যথেষ্ট সম্মান করি।   আপনাদের বিজ্ঞ, লার্নড অ্যাডভোকেট বলি, আপনারা ৫০ জন যদি নিয়োজিত হন, আপনারা বসে শৃঙ্খলা করে একজন বলেন, দুজন বলেন।   কিন্তু আদালতের শৃঙ্খলা যাতে কোনভাবে নষ্ট না হয়।  

একই অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, আপনাদের আমি সবিনয়ে বলতে চাই, আমি একজন আইনজীবী।   আমরা জানি, বার ও বেঞ্চ একটি আরেকটির পরিপূরক।   বেঞ্চের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা শুধু বেঞ্চের ভাবমূর্তি বাড়ায় তা না।   বারেরও ভাবমূর্তি বাড়ায়।   দেশেরও ভাবমূর্তি বাড়ায়।   আপনারা সবসময় সেই কথাটা মনে রাখবেন।

বুধবার (১৮ জানুয়ারি) বিকেলে মানবপাচার আইনের মামলার আসামি এক আইনজীবী ও তার স্ত্রীকে জামিন না দেয়ায় অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম সাহাদাৎ হোসেন ভূঁইয়ার এজলাসের ভেতরে ও খাস কামরার বাইরে ভাংচুর করেন আইনজীবীরা।   এরপর আরেকটি আদালতে শুনানি করে সন্ধ্যায় ওই আইনজীবী এবং তার স্ত্রীকে জামিন দেয়া হয়।

চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মো.হেলাল চৌধুরীর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো.জহিরুল হক, রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার রহুল আমিন, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী।

এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুন্সী মো. মশিয়ার রহমান।

এর আগে প্রধান বিচারপতি নবনির্মিত ভবনের ফলক উন্মোচন করেন।

* আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে: প্রধান বিচারপতি

বাংলাদেশ সময়: ২০১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৭

আরডিজি/টিসি

 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।