পটিয়া থেকে ফিরে: চার বোন। উম্মে হাবিবা চৌধুরী, উম্মে সালিমা চৌধুরী, উম্মে তাসলিমা চৌধুরী এবং উম্মে তানজিলা চৌধুরী।
দৃষ্টিশক্তি নিয়ে জন্ম নিতে না পারলেও চার বোনের জীবন থেমে যায়নি।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তিন শিক্ষক বোনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের জীবনসংগ্রামের কথা। নিজেরা অন্ধ হয়েও শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে সমাজকে আলোকিত করছেন যারা তাদের জন্য বাংলানিউজের বিশেষ আয়োজন ‘জন্মান্ধ তিন বোন ছড়াচ্ছে আলো’।
তিন বোনই অভিন্ন কন্ঠে বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় আমরা চার বোন হওয়ার কথা ছিল মা-বাবা, পরিবার আর সমাজের বোঝা। কিন্তু শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির জোরে আমরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি। আমরা প্রমাণ করেছি আমরা অসহায় নয়, আমরা সমাজের বোঝা নয়, আমরা কারও করুণার পাত্র নয়।
নগরীর হামজারবাগ এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো.নাছির উদ্দিন চৌধুরী এবং শামীমা আক্তার চৌধুরীর চার মেয়ে, এক ছেলে। ছেলের দৃষ্টিশক্তি ঠিক থাকলেও চার মেয়েই জন্মান্ধ। তাদের বাড়ি পটিয়ার কচুয়াই উপজেলার আজিমপুর গ্রামে।
চার বোনই নগরীর মুরাদপুরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর হাবিবা, সালিমা ও তাসলিমা বন গবেষণাগার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং তানজিলা রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে হাবিবা ও তানজিলা হাজেরা তজু কলেজ এবং সালিমা ও তাসলিমা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ব্রেইল পদ্ধতিতে এইচএসসি পাশ করে চার বোনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান।
হাবিবার জন্ম ১৯৮৩ সালের ১ ডিসেম্বর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন অনুষদে মাস্টার্স করে এখন পটিয়া পৌরসভায় শশাংকমালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা।
তাসলিমার জন্ম ১৯৮৯ সালের ৩০ মে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করে এখন পটিয়া পৌরসভায় দক্ষিণ গোবিন্দারখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা।
তানজিলার জন্ম ১৯৯৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ব বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী। তিনি পটিয়া পৌরসভার মোহছেনা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা।
লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর তিন বোন পটিয়া পৌরসভার তিনটি সরকারি স্কুলে যোগ দেন।
মেঝ বোন সালিমাও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ব বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। তিনি বিসিএস দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ছোট বোন তানজিলা।
তাদের একমাত্র বড় ভাই মো.নাইম উদ্দিন আর্ন্তজাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ-এমবিএ করেছেন। তিনি বর্তমানে বায়িং হাউজে চাকরি করছেন।
সকাল ১০টার দিকে মোহছেনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রাক প্রাথমিক শ্রেণীতে ৫০-৬০ জন মুখে সদ্য বোল ফোটা শিশুর সামনে দাঁড়িয়ে গল্প বলছেন তানজিলা। পাশে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে আছেন এক পুরুষ শিক্ষক। তিনি মূলত তানজিলাকে সহযোগিতা করছিলেন। তানজিলার পাঠদানের ভঙ্গি, কথা বলা-কিছুতেই বোঝা যাচ্ছিল না তিনি একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।
দীবা বড়ুয়া ও হুমায়রা বিনতে খলিল নামে দুই খুদে শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তারা বাংলানিউজকে বলেন, ‘টিচার আমাদের অ, আ, ক, খ পড়ায়, ছড়া পড়ায়। টিচার খুব ভালো। আমাদের গান শেখায়, ব্যায়াম শেখায়। টিচার খুব আদর করে। ’
প্রাক প্রাথমিক, তৃতীয় শ্রেণী, চতুর্থ শ্রেণীর ক্লাস নেন তানজিলা। মাঝে মাঝে পঞ্চম শ্রেণীতেও পড়ান।
মোহছেনা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাজমুন নাহার বাংলানিউজকে বলেন, শিশুরা একটু চঞ্চল আর দুষ্টু হয়। সেজন্য তানজিলাকে সহযোগিতা করতে একজন টিচার দিই। না হলে, ওর পড়ালেখার ধরন খুব ভাল। ছাত্রছাত্রীরাও তাকে খুব পছন্দ করে। আমরা সহকর্মীদেরও সে খুবই প্রিয়। দৃষ্টিশক্তি আছেন এমন একজন টিচারের কাছ থেকে আমি যে কাজ পাই, তানজিলাও আমাকে সমান সাপোর্ট দেয়।
তানজিলা বাংলানিউজকে বলেন, ইচ্ছা ছিল এনজিওতে কাজ করব। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় আমরা তিন বোন টিকে যাই। এরপর শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পড়েছি। ছাত্রছাত্রী আর সহকর্মীরা আমাকে এত ভালবাসেন যে এখন তাদের মায়ার জালে জড়িয়ে গেছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলতি বছর মাস্টার্স পরীক্ষা দেবেন তানজিলা। ছাত্রজীবনে গান শিখেছেন। স্কুলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি গানও শেখান তানজিলা। ক্যাম্পাসে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা উদীচীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু পটিয়ায় উদীচীর কর্মকাণ্ড না থাকায় চারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তানজিলা।
‘আমি সংস্কৃতিকে ভালবাসি, গানকে ভালবাসি। আমি সংস্কৃতির সঙ্গে থাকতে চাই। সেজন্য উদীচী-চারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমার মন খারাপ হলে আমি এ লড়াই বাঁচার লড়াই-গানটি গাই। এতে আমি মনের জোর পাই। লড়াই করার শক্তি পাই। ’ বলেন তানজিলা।
তানজিলাকে গত ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে পুরস্কৃত করেন শেখ হাসিনা। এসময় টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমও উপস্থিত ছিলেন। ভবিষ্যতে শিক্ষা ক্যাডারে বিসিএস দেয়ার পাশাপাশি একটি গানের স্কুল করার আকাঙ্খার কথা জানিয়েছেন সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকা তানজিলা।
তাসলিমার সঙ্গে দক্ষিণ গোবিন্দারখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা হয়। তিনি তখন পঞ্চম শ্রেণীতে বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়ের ক্লাস নিচ্ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল ? শিক্ষার্থীরা সমস্বরে জবাব দিচ্ছে-স্বাধীনতার জন্য। তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন, স্বাধীনতা এসেছিল কার নেতৃত্বে ? শিশুরা বলছিল-বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে।
তাসলিমা জানালেন, তাকে কারও সহযোগিতা করতে হয়না। তিনি অন্ধ, এটা জেনে ছোট ছোট শিশুরাও তাকে খুব আপন করে নিয়েছে। এজন্য তাদের পড়াতে তার কোন বেগ পেতে হয়না।
তাসলিমা বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা তিন বোন আত্মনির্ভরশীল। আমাদের কেউ ফিডব্যাকের আশায় সহযোগিতা করবে কিংবা করুণা করবে, সেটা আমরা মানতে পারিনা। অন্ধ হলেও আমরা যদি মানুষের মতো সম্মান পায় সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। ’
তাসলিমাও ইচ্ছা শিক্ষা ক্যাডারে বিসিএস পরীক্ষা দেবার। তিনিও গান করেন। তিনিও ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করতে পারেন।
দক্ষিণ গোবিন্দারখীল সকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা দিলুয়ারা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘তাসলিমারা তিন বোনকেই আমি ভালভাবে চিনি, জানি। আমি শুধু এতটুকু বলতে পারি, চোখে না দেখলেও তারা আমাদের চেয়ে কম নয়। বরং আমাদের চেয়ে বেশি উপস্থিত বুদ্ধি তাদের আছে। যে কোন বিষয় দ্রুত ডেলিভারি দেয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা তাদের আছে। ’
উম্মে হাবিবার সঙ্গে দেখা করতে দুপুরে শশাংকমালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তিনি ছাত্রদের অ্যাসেম্বলি করাচ্ছেন। সাথে আছেন অন্য শিক্ষকরাও। উম্মে হাবিবা গান করেন। বিশেষত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে তিনি খুবই পারদর্শী। ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরিতেও তার জুড়ি নেই।
তিনি বলেন, আমি এলএলএম করেছি। আমার উকিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি শিক্ষকতাকে ভালবেসে এই পেশায় এসেছি। সহকর্মীরা নি:স্বার্থভাবে আমাকে সহযোগিতা করেন। আমার সঙ্গে একজন টিচার থাকেন, যিনি ক্লাসে আমাকে সহযোগিতা করেন।
‘এই পেশায় এসে আমার অনেক ভাল লাগছে। আমি অন্ধ হয়েও আলো ছড়াতে পারছি। আমি সমাজকে কিছু দিতে পারছি। সমাজকে আলোকিত করছি, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই নেই। ’ বলেন হাবিবা।
শশাংকমালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা চাঁদ সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, ‘দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও উম্মে হাবিবা যা করছে, দৃষ্টিশক্তি থাকলেও তার চেয়ে বেশি করতে পারত কিনা সন্দেহ আছে। আল্লাহ ওদের সব দিয়েছে, শুধু চোখটা ছাড়া। কিন্তু নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে সেই অপূর্ণতাকে তার অপূর্ণ রাখেনি। উম্মে হাবিবার মতো এত ধৈর্যশীল শিক্ষক আমি খুব কম দেখেছি। ’
একই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা শর্মিলা দাশ বাংলানিউজকে বলেন, উম্মে হাবিবা আপা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও এমন কোন কাজ নেই যা তিনি করতে পারেন না। তিনি শিক্ষকতা করেন, গান করেন, ভাল রান্নাও করেন। এমনকি সহকর্মীদের বাসায় দাওয়াত দিয়ে তিনি খাইয়েছেন।
তিন বোনের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকাকে সবচেয়ে বড় করে দেখেন তারা। তাসলিমা বাংলানিউজকে বলেন, অনেক মা-বাবা তার প্রতিবন্ধী সন্তানের পরিচয় দিতে কুন্ঠাবোধ করেন। বাসায় অতিথি আসলে ড্রইংরুমে সবাই থাকে, শুধু প্রতিবন্ধী সন্তানটা ছাড়া। কিন্তু আমার মা-বাবা এমন নন। তারা আমাদের এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে সবসময় সহযোগিতা করেছেন। তাদের কারণেই আমাদের এতদূর আসা।
‘শুধু ইচ্ছাশক্তি লাগবে। লজ্জা-ভয় ফেলে দিতে হবে। আত্মবিশ্বাস লাগবে। তাহলে চোখের সামনে কোন বাধাই আর বাধা থাকবেনা। ’ অভিন্ন কন্ঠে বলেন তিন বোন।
মা-বাবা ছাড়াও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সামাদের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন তিন বোন। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা সহযোগিতার কথাও জানিয়েছেন তারা।
পটিয়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন তারা। নিজেরাই রান্নাবান্না থেকে সংসারের সব কাজ করেন। মাছ-মাংস, তরকারি কাটার কাজও নিজেরাই করেন।
উম্মে হাবিবা বাংলানিউজকে বলেন, ‘এক কেজির চেয়ে বড় মাছ হলে কাটতে একটু সমস্যা হয়। না হলে অন্য কোন সমস্যা নেই। আমি পুডিং, নুডলস সব বানাতে পারি। ’
তানজিলা বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি সকালে উঠে চা বানাই। ভাত রান্না করি। ধোয়ামোছা করি। তিন বোন মিলেমিশে সংসারের কাজ করি। ’
জন্মান্ধ তিন বোন তাদের আয়ের টাকায় বাবা-মাকেও সহযোগিতা করেন। তাসলিমা বাংলানিউজকে বলেন, আমার বাবার প্রয়োজন নেই। তারপরও বাবাকে সহযোগিতা করি। মাঝেমধ্যে টাকাপয়সা দিই। কিংবা গিফট কিনে দিই। বাবা-মা খুব খুশি হন।
শুধু নিজের পরিবার নয়, জন্মান্ধ তিন বোনই জানালেন, সমাজের মানুষের জন্য, প্রতিবন্ধীদের জন্য তাদের অনেক কিছুই করার ইচ্ছে আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৬
আরডিজি/টিসি