ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

শৃঙ্খলা নেই সিএমপিতে, বাড়ছে অপরাধ

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৩ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৪
শৃঙ্খলা নেই সিএমপিতে, বাড়ছে অপরাধ

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম নগরীতে গত কয়েক মাসে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেছে। একইসঙ্গে নগর পুলিশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা এবং তৎপরতাও দৃশ্যত কমে গেছে।

সার্বিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগের মধ্যে আছেন নগর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

নগর পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, ব্যাপক সহিংসতা মোকাবেলা করে গত ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর থেকে নগর পুলিশের চেইন অব কমান্ড নড়বড়ে হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের কারণে টিমওয়ার্ক নষ্ট হয়ে গেছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকজন ওসি’র উপর শীর্ষমহলের কার্যত কোন নিয়ন্ত্রণই নেই।  

এর পাশাপাশি ওসি থেকে পরবর্তী নিচের স্তরের বেশকিছু পুলিশ সদস্য নিজেরাই অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে বলে তথ্য আছে নগর পুলিশের কাছে। এমনকি সদরঘাট থানার একজন উপ-পরিদর্শকের (এস আই) বিরুদ্ধে জোড়া খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

অভিযোগ আছে, নগর পুলিশের বিভিন্ন পদে বিশেষত ওসি পদে নিয়মিত রদবদল করা হচ্ছে না। একই ব্যক্তি একই পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের  প্রভাব পড়ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (সদর) মাসুদ-উল-হাসান বাংলানিউজকে বলেন, টিমওয়ার্ক কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে এটা অস্বীকার করা যাবেনা। যেসব অপরাধ ঘটছে তাকে খুব বেশি অ্যালার্মিং মনে করছিনা। তবে উপর থেকে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে।

রদবদল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দায়িত্ব পালনে কেউ ব্যর্থ হলে তাকে সরানো হচ্ছে। আমাদের কমিশনার মহোদয় এ বিষয়ে খুবই কঠোর। তবে ঢালাও রদবদল কাজের পরিবেশ নষ্ট করে।

পাঁচ মাসে ৪৫ খুন
চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন থানায় গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে খুনের মামলা রেকর্ড হয়েছে ৩৯টি। চলতি মে মাসে খুনের মামলা রেকর্ড হয়েছে কমপক্ষে ৬টি।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দৃশ্যত স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জানুয়ারি মাসে নগরীতে ১৫টি খুনের মামলা রেকর্ড হয়েছে। অথচ সহিংসতাপ্রবণ পরিস্থিতিতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে খুনের মামলা হয়েছিল মাত্র ৮টি। এপ্রিলে চট্টগ্রাম নগরীতে খুন হয়েছেন ১২ জন। অথচ মারাত্মক অস্থিতিশীল সময়ে ২০১৩ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রাম নগরীতে খুন হয়েছিল ৫ জন।

গত পাঁচ মাসে বেশ কয়েকটি নৃশংস খুনের ঘটনা চট্টগ্রাম নগরীতে আলোড়ন তুলে। এর মধ্যে ১৭ মার্চ নগরীর জিইসি মোড়ে দু’ছাত্রলীগ কর্মীকে খুনের পর লাশ সেফটিক ট্যাংকে রেখে দেয়া, ২৪ মার্চ আগ্রাবাদে মা ও মেয়েকে কুপিয়ে ও হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা এবং ৩ মে নগরীর সদরঘাট থানার একটি হোটেলে দু’জনকে হত্যার পর লাশ মিরসরাই ও সিআরবিতে ফেলে দেয়া এবং গত ১৯ মে নগরীর বিআরটিসি এলাকার আল আরাফাত হোটেলে এক যৌনকর্মী তরুণীকে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যার ঘটনা অন্যতম।

শুধু খুন নয়, সিএমপিতে অন্যান্য অপরাধেরও রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। জানুয়ারিতে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, মোটর সাইকেল চুরি, মাদক উদ্ধার, অস্ত্র উদ্ধার, ধর্ষণ, খুনসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৪৯টি। ফেব্রুয়ারিতে এসব অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে ৩৫৪টি। মার্চে মামলা হয়েছে ৪১৯টি এবং এপ্রিলে ৪৪১টি মামলা হয়েছে।

সিএমপিতে রেকর্ড হওয়া অপরাধের হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতি মাসেই মামলার সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ এপ্রিলে আগের বছরের এপ্রিলের চেয়ে ১৩২টি ‍মামলা বেড়েছে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে সিএমপিতে মামলা রেকর্ড হয়েছিল ৩০৯টি।

নগর পুলিশের উপ কমিশনার মাসুদ-উল-হাসান বাংলানিউজকে বলেন, খুলশী আর কোতয়ালীতে অপরাধ বেশি। ডবলমুরিং, বায়েজিদেও আছে। কমিশনার মহোদয় সংশ্লিষ্ট ওসিদের বেশ কয়েকবার সতর্ক করেছেন। তারাও সাধ্যমত অপরাধ প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন।

জোড়া খুনে জড়িত এস আই ! 
গত ৪ মে নগরীর সিআরবি কাঠের বাংলো এলাকা থেকে এক ক্ষতবিক্ষত যৌনকর্মীর লাশ উদ্ধার করে কোতয়ালী থানা পুলিশ। একইদিন নগরীর মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ ওই এলাকা থেকে বস্তাবন্দি যুবকের লাশ উদ্ধার করে।

পুলিশ সূত্র জানায়, জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ লাশ উদ্ধারের মামলার তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে, বস্তাবন্দি যুবকের নাম হাবিব। সে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত নারীদের সর্দার। নগরীর সদরঘাট থানার আকাশ হোটেলে ছিল তার আস্তানা। সেখানে অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিয়ে ৩ মে রাতে হাবিব খুন হয়। একইসঙ্গে খুন হয় যৌনকর্মী মায়া পরদিন যার লাশ সিআরবিতে পাওয়া যায়। এ খুনের ঘটনার সময় সদরঘাট থানার এস আই ইয়ার আলী আকাশ হোটেলে অবস্থান করছিল বলে তথ্য আছে জোরারগঞ্জ থানা এবং নগর পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে। বিষয়টি নগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করে দেখছে।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, এস আই ইয়ার আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাবার পর তার মোবাইলের কললিস্ট চেক করা হয়েছে। দেখা গেছে, ঘটনার আগের দিন সকাল থেকে সে কুষ্টিয়ায় তার গ্রামের বাড়িতে ছিল। ঘটনার পরও তার অবস্থান কুষ্টিয়ায় দেখা গেছে। আমরা আরও বিশদভাবে তদন্তের জন্য ডিবিকে দায়িত্ব দিয়েছি।

তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে ইয়ার আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে এখনও কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

তবে এস আই ইয়ার আলী বাংলানিউজের কাছে ঘটনার সঙ্গে তার জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

অভিযোগ আছে, সদরঘাট থানা পুলিশের জ্ঞাতসারেই আকাশ হোটেলে অসামাজিক কার্যকলাপ চলত। একইভাবে আল আরাফাত হোটেলে অসামাজিক কার্যকলাপের বিষয়েও অবগত ছিল কোতয়ালী থানা পুলিশ। খুলশী, বন্দর, হালিশহর, পাহাড়তলী, ডবলমুরিং থানার জ্ঞাতসারেও বিভিন্ন হোটেল, আবাসিক ফ্ল্যাটে, কথিত ম্যাসেজ পার্লার আর রেস্টুরেন্টে একই ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চলে বলে অভিযোগ আছে।

সদরঘাট থানার ওসি প্রণব চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আকাশ হোটেলে অসামাজিক কার্যকলাপ চলত এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আমরা বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজেনকে গ্রেপ্তার করেছিলাম।

কোতয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নেজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, জ্ঞাতসারে কোতয়ালী থানার অধীনে কোন হোটেলে অসামাজিক কার্যকলাপ চলতে আমরা দিইনি, ভবিষ্যতেও দেবনা।

চেইন অব কমান্ড দুর্বল
নগরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি আওয়ামী লীগের চট্টগ্রামের একটি সাংগঠনিক জেলা কমিটির সহ সভাপতির সন্তান। তিনি প্রকাশ্যেই সিএমপিতে এক মন্ত্রীর দাপট দেখান বলে অভিযোগ আছে। রাজনৈতিক দাপটে ওই ওসি একমাত্র সিএমপি কমিশনার ও একজন অতিরিক্ত কমিশনার ছাড়া আর কারও আদেশ-নির্দেশ পালন করেন না। ওই ওসি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জোনের উপ-কমিশনার, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার, সহকারী কমিশনার কারও সঙ্গেই সুসম্পর্ক নেই, তিনিও থানার কোন তথ্য তাদের কাছে সরবরাহ করেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগর পুলিশের একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, জোনের দুজন শীর্ষ কর্মকর্তা ওসি’র বিরুদ্ধে পুলিশ কমিশনারের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। পুলিশ কমিশনার ওসিকে ডেকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু ওসি এই মৌখিক সতর্কতাকে পাত্তাও দেননি।

একসময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার পরিচয় ও প্রভাবে নগরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ থানায় দীর্ঘদিন ধরে ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আরেকজন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কাভার্ড ভ্যান ডাকাত চক্রসহ দাগী অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার অভিযোগ আছে। পাশের জোনের আরেকজন ওসির বিরুদ্ধে এলাকায় মাদক স্পট থেকে নিয়মিত টাকা নেয়ার অভিযোগ আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার পদমর্যাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অধিকাংশ ওসি শীর্ষ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠ এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। তারা প্রভাবশালী নেতাদের নাম ভাঙ্গিয়ে চলেন। সংসদ নির্বাচনের পর স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে বেপরোয়া ভাব এসেছে। এতে টিমওয়ার্ক নষ্ট হয়ে গেছে।

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (সদর) মাসুদ-উল-হাসান বাংলানিউজকে বলেন, কিছুটা সমস্যা থাকলেও নগর পুলিশের কার্যক্রম জোরদার হয়েছে। মাদক স্পট চিহ্নিত করে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে সিসিটিভি বসানো হচ্ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৩ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।