ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

গাছ কাটার মহোৎসব

বিরাণভূমিতে পরিণত হচ্ছে ছায়া সুনিবিড় বিস্তির্ণ এলাকা

রমেন দাশগুপ্ত ও আবদুল্লাহ আল মামুন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৪
বিরাণভূমিতে পরিণত হচ্ছে ছায়া সুনিবিড় বিস্তির্ণ এলাকা ছবি: উজ্জ্বল কান্তি ধর / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম নগরীর টাইগারপাস থেকে পাহাড়তলী পুলিশ বিট পর্যন্ত রেলওয়ের মালিকানাধীন সড়কে গাছ কাটার উৎসব চলছে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থাপনার বুক চিড়ে যাওয়া পিচ ঢালা পথের পাশে ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন গাছগুলো কেটে পুরো এলাকাকে বিরাণ ভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে।



গাছগুলো কেটে নেয়ার বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষকে কিছুই জানানো হয়নি। রেলওয়ের জায়গায় সিটি কর্পোরেশনের সড়ক সম্প্রসারণকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরিচয়ধারী স্থানীয় ভূমিদস্যুদের প্রভাবশালী একটি চক্র নির্বিচারে গাছগুলো কেটে নিয়ে যাচ্ছে।


ছায়া সুনিবিড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার, কোনটি শতবর্ষী, কোনটি অর্ধশত বছরের প্রাচীন গাছগুলো বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি রেলওয়ে কিংবা সিটি কর্পোরেশন।

গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ নেতা ও চসিকের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হিরণ এবং যুবদলের সোহেল ও আরমানসহ আরও কয়েকজন গাছগুলো কাটার নির্দেশ দিয়েছেন।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মকবুল আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন,‘সিটি কর্পোরেশন রাস্তা সম্প্রসারণ করার বিষয়ে আমাদের কাছ থেকে কোন অনুমোদন নেয়নি। গাছ কাটার অনুমতিও আমরা কাউকে দিইনি। গাছ কাটার খবর পেয়ে আমি ডিআরএম (ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার) এবং কয়েকজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বিষয়টি তদন্ত করে পুলিশকে জানানোর নির্দেশ দিয়েছি। ’

নগরীর টাইগারপাস মোড় থেকে পাহাড়তলী পুলিশ বিট হয়ে পাঞ্জাবি লেইন পর্যন্ত এলাকাটি রেলওয়ের মালিকানাধীন। সেখানে রেলওয়ের ওয়ার্কশপ, প্রকৌশল বিভাগের বিভিন্ন স্থাপনা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন আছে। কয়েক কিলোমিটারব্যাপী এলাকাটিতে রাস্তার দু’পাশে আছে বিভিন্ন গাছের সারি। রাস্তার পাশে রেলওয়ের ভূমিতেও আছে বিভিন্ন ধরনের গাছের বাগান। গাছ-গাছালিঘেরা সড়ক ধরে প্রতিদিন প্রাত:ভ্রমণে বের হন নগরবাসী।

শনিবার সকালে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তার দু’পাশে থাকা রেইনট্রি, মেহগনি, কৃঞ্চচূড়া, রাধাচূড়া, বটগাছ, নিমগাছসহ আরও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। শ’খানেক শ্রমিক খুবই উৎসাহের সঙ্গে গাছ কাটায় অংশ নিয়েছে। যুবক বয়সী কয়েকজনকে এ গাছ কাটার অভিযান তদারক করতে দেখা গেছে। দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রায় ২০-৩০টি গাছ কাটা অবস্থায় দেখা গেছে।

মধ্যবয়সী এক শ্রমিক বাংলানিউজকে বলেন, হিরণ ভাই আমাদের গাছ কাটতে বলেছেন। রাস্তা বড় করতে হবে। এজন্য রাস্তার দুইদিকে যত গাছ আছে সব গাছ কাটা হবে।

এলাকার বাসিন্দা এক গৃহবধূ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, কাল (শুক্রবার) সকাল থেকে গাছ কাটা হচ্ছে। আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি করাত দিয়ে গাছ কাটা হচ্ছে। এত সুন্দর, সুন্দর গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে দেখে খুব খারাপ লাগছে।

এলাকার লোকজন জানান, রেলওয়ে পাবলিক স্কুলের সামনে একটি রেইনট্রি গাছ কাটা হচ্ছে, যে গাছের বয়স শত বছরেরও বেশি। রেলওয়ে জাদুঘরের সাইনবোর্ডের অদূরে কমপক্ষে অর্ধশত বছরের পুরনো একটি বটগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বড় আকারের একটি নিমগাছ কেটে ফেলা হয়েছে, যেটি কমপক্ষে ৩০-৩৫ বছর ধরে এলাকার লোকজন দেখছেন।

সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীর অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হোসেন হিরণের মোবাইলে অনেকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

তবে ঘটনাস্থলে গিয়ে সাংবাদিকরা গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত মো.আরমানের দেখা পান। তিনি সাংবাদিকদের জানান, সিটি কর্পোরেশন গাছ কাটার কার্যাদেশ দেওয়ায় তারা গাছ কাটছেন। যেসব গাছ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে সেগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। কাটার পর গাছের সংখ্যা নির্ধারণ করা হবে।

তবে কাউকে গাছ কাটার কার্যাদেশ দেয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী ছালেহ আহমেদ। তিনি টাইগারপাস থেকে পাহাড়তলী পুলিশ বিট পর্যন্ত সড়ক সম্প্রসারণের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ছালেহ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সড়ক সম্প্রসারণের জন্য গাছ কাটার অনুমোদন আমরা কাউকে দিইনি। ৪-৫টি গাছ কাটার প্রয়োজন থাকলেও আমরা সেগুলোকে রেখেই সম্প্রসারণের কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

গাছ কারা কাটছে অবগত নন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি বৃহস্পতিবার প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। তখনো গাছগুলো দেখেছি। শুক্র-শনিবার বন্ধের দিন হওয়ায় দুস্কৃতিকারীরা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গাছগুলো কেটে নিয়ে যাচ্ছে।

সিটি কর্পোরেশনের এ বক্তব্য পাবার পর আবারও যোগাযোগ করা হয় আরমানের সঙ্গে। তিনি মোবাইলে বাংলানিউজকে বলেন, আমি শুধু শ্রমিক সাপ্লাই দিয়েছি। গাছ কে কাটছে আমি জানিনা।

কার নির্দেশে শ্রমিক সরবরাহ করছেন জানতে চাইলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলওয়ের সড়ক অনুমোদন ছাড়া সিটি কর্পোরেশন সম্প্রসারণ শুরু করায় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিল রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন রেলওয়ের ওই প্রতিবাদকে আমলেই নেয়নি।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মকবুল আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারদের ফোন করলে তারা ফোন ধরেনা। অনেক সময় মোবাইল বন্ধ করে রাখে। আমাদের গাছ তারা কেন কাটার অনুমোদন দিল কিংবা আদৌ তারা অনুমোদন দিয়েছে কিনা বিষয়টি তাদের কাছে জানতে চাইব। গাছগুলো আমাদের ঐতিহ্য ছিল। সেগুলো এভাবে কেটে ফেলার বিষয়টি আমরা মানতে পারছিনা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬,২০১৪ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।