ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘আমরা এখন সাংস্কৃতিকভাবে দেউলিয়া হতে বসেছি’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৪

ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন: ১৯৪৮ সালে ২৪ মার্চ সমাবর্তন সভায় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনের বক্ততায় যখন বলেন ‘ÔUrdu and Urdu shall be state language of pakistan’ তখন সাথে উপস্থিত নো নো বলে প্রতিবাদ জানাই। এবং আমার সাথে সাথে অন্য ছাত্ররাও নো নো বলে চিৎকার করে ওঠে।

দাঁড়িয়ে স্লোগান শুরু করি আমরা। সবাই একত্রে স্লোগান দিতে থাকি।
পরিস্থিতি খারাপ দেখে জিন্নাহ সাহেব তখন তাড়াতাড়ি বক্তৃতা শেষ করে সিকিউরিটি নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করেন। এরপর হট্টগোলের মধ্যে মিশে আমি হল থেকে বের হলাম। আমার বন্ধুরা কেউ কেউ বাহবা দিতে শুরু করে। অনেকে আমাকে বলে তুই তো বিপদে পড়বি। এসব ব্যাপারে তোর মাথা ঘামাতে হবে না। এগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। তোর এতো কিসের জ্বালা? তবে এ কাজটা করে আমি কি যে আনন্দিত হয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এ কাজ আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি নিজেও নিজেকে ধন্য মনি করি যে, আমি তো ওই সাহসী কাজটা করেছিলাম। এর তিন মাস পরে জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর খাজা নাজিমুদ্দিন, লিয়াকত আলী খানসহ আরো অনেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

১৯৪৮ সালে নাকি বাংলাকে রাষ্টভাষা করার বিরোধিতা করে একটা গোষ্ঠী, তারা কারা?

বাংলাকে পাকিস্তানের ভাষা কারার আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঢাকায় শাসক গোষ্ঠীর প্রচারণায় আদিবাসীদের একটা ক্ষুদ্র নগন্য অংশ বাংলাকে রাষ্টভাষা করার বিরোধিতা করেছিলো। এছাড়া আর কোনো বিরোধিতার খবর আমাদের কানে আসেনি।

আপনাকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’র আহবায়ক করা হয়। সে সময়ে আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

হঠাৎ করেই আমাকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’র আহ্বায়ক করা হলো। এত বড় গুরুদায়িত্ব আমি কিভাবে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়া পরিচালনা করি? একজন আহ্বায়ককে কিভাবে কমিটি পরিচালনা করতে হয় তাও আমি জানি না। কমিটি সদস্যদের বৈঠকে উপস্থিত করার জন্যে আমি একজন অভিজ্ঞ কর্মীর পরামর্শ চাইলাম। তিনি বললেন, কমিটি সদস্যদের বৈঠকে ডাকার জন্যে একটি নোটিস বই করুন। সেই নোট বইয়ে কোন কোন তারিখে কোন কোন স্থানে বৈঠক হবে তার আলোচনা থাকবে। এভাবে ১৯৫০ সালে আমি দুটো সভার নোটিশ দিলাম। অর্থসংগ্রহ কার্যক্রম, প্রেস বিজ্ঞপ্তি, যারা বৈঠকে আসবে না তাদের বহিষ্কার— এসব করলাম। পঞ্চম বৈঠকে আমি আর অল্প কয়েকজন ছাড়া বাকিদের না পেয়ে নতুন ৮ জনকে নিয়ে ৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হলো। সেই কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় ৫ এপ্রিল ১৯৫১ সালে ‘পতাকা দিবস’ পালন করা হবে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ মার্চ পর্যন্ত বড় বড় নেতারা ভাষা অন্দোলন  প্রসঙ্গে একটি আঙ্গুল পর্যন্ত উত্তোলন করেননি, মিছিল মিটিং তো দূরের কথা। আমার ছাত্ররা মিলেই গণসংযোগের মাধ্যমে টাকা পয়সা সংগ্রহ করতাম। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আমার তা করেছি। এভাবে পুনরায় ভাষা অন্দোলন বিকশিত হতে থাকে। তারপর আবার গণঅর্থ সংগ্রহ করে আমার ছোট ছোট পতাকা তৈরি করে তাতে লিখি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রম কমিটি’র সাথে আর কারা কারা জড়িত ছিলেন?

নবগঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের প্রথম বৈঠক হয় ১৩ মার্চ ১৯৫১ সালে। মাকসুদ আহমদের সভাপতিত্বে এ বৈঠকে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত থাকেন হাবিবুর রহমান শেলী, আমি, বদিউর রহমান, মোশারফ হোসেন, আবদুল ওয়াদুদ, নূরুল আলম, ও তাজউদ্দীন আহমদ। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আমার স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও সংবাদপত্রে পাঠানো হয়। পরে আরো অনেকে এর সাথে জড়িত হয়, সালেহউদ্দিন, রুহুল আমীন চৌধুরীসহ আরও অনেকেই।

আপনি কতো সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হন? ঠিক কোন অপরাধে আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়?

১৯৪৫ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পাস কোর্সে ভতি হই। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি এই তিনটি বিষয়ের শিক্ষকরা প্রত্যেকই নাম করা পণ্ডিত ছিলেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সিঁড়ির পাশে পাঁচ নাম্বার রুমে থাকতাম। ১৯৪৮ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে মাস্টার্সে ভতি হই। তৎকালীন সরকার আমাকে সিএসপি বানিয়ে ভাষা অন্দোলন থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। আমি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঁচ নাম্বার ওয়াল্ডে থাকতাম। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক রাজনৈতিক নেতা থাকতেন। হঠাৎ জেলারের মাধ্যমে আমাকে পুলিশ অফিসার একটা কাগজ দেখালেন। তাতে লেখা ছিল ‘আই শ্যাল সার্ভ অ্যানি গভর্নমেন্ট দ্যাট কামস টু পাওয়ার মোস্ট অবিডিয়েন্টলি অ্যান্ড সাবসার্ভিয়েন্টলি। ’ কখনো আর কোনো আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারবো না এই মর্মে একটা স্বাক্ষর দিতে হবে। আমি তা দিই নি। আবার জেলার অফিসার এসে বললেন ‘এখনো সময় আছে ভালোভাবে চিন্তা করে দেখেন। প্রস্তাবে রাজি হলে বাড়ি গাড়ি পেতাম। আমি কিন্তু সেই প্রস্তাবে সাড়া দিইনি। তখন অফিসার বললেন ‘আপনার মতো নির্লোভ মানুষ দেখিনি। ব্যক্তিগত জীবনে আমি এসব বিষয়ে কোনো তোয়াক্কা করিনি। এ ঘটনার দুমাস পরে আমি জেল থেকে মুক্তি পাই। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি মুসলিম লীগের অনুসারী ছিলেন। তিনি আমাকে তার অফিসে ডেকে নিলেন এবং অশালীন আচরণ করে বললেন এখানে পড়তে হলে তোমাকে বন্ড সই করতে হবে। আমি বললাম আমার কোনো অপরাধ নেই, আমি কেন বন্ড সই করবো। তিনি আমাকে তিন বছরের জন্যে বহিষ্কার করলেন এবং হল ছাড়ার নির্দেশ দিলেন।

এরপর কোথায় উঠলেন? আর কিভাবে চললেন?

ইকবাল হলে গিয়ে উঠলাম। তখন ইকবাল হল ছিল বাশের তৈরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সেখানে ভাড়া দিয়ে থাকতে পারতো। যদিও সারাটা সময় দুঃচিন্তার মধ্যে কাটাতে হতো। টিউশনি শুরু করি। ড. কামাল হোসেনের এক মামা আমার বন্ধু ছিলো। তার নাম আলী কবীর। পরে সে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর হয়। ও আমাকে টিউশনি জোগাড় করে দেয়। কামাল হোসেনের পরীক্ষার মাত্র তিন মাস বাকি থাকতে তাকে পড়াতে শুরু করি। পরীক্ষায় ও ভালো রেজাল্ট করে। আমি তাকে পড়াতাম। তখন প্রতিমাসে টিউশনী করে চল্লিশ টাকা ইনকাম করতাম।

পাকিস্তান হবার পর রাষ্ট্রভাষা অন্দোলনই সর্বপ্রথম এক গণঅভ্যূত্থান। এই গণঅভ্যূত্থানের সাথে আপনার সম্পর্ক ছিল অঙ্গাঙ্গি। শুনতে চাই সেসব দিনের কিছু কথা।

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হবার পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিকালে কর্মপরিষদের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনের মিছিলটি ছিল বিশাল। সভা শেষে প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্রছাত্রীর এক সুদীর্ঘ মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে সদরঘাট থেকে চকবাজার হয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। সাধারণ মানুষ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে এবং পুষ্পাজ্ঞলির মাধ্যমে অভিনন্দন জানায় আমাদের।

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে যে মতামত দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে জানতে চাই।

২০ ফেব্রুয়ারি এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার অন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়তো। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ১১ জন মত প্রকাশ করেছিলেন সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা মেনে নিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। আর তার বিপরীতে মাত্র ৪ জন, অলি আহাদ, গোলাম মাওলা, শামসুল আলম, এবং আমি আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দিই।

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার গল্পটা শুনতে চাই।

২১ ফেব্রুয়ারি এক অভ্যূত্থান হলো। আমি সেদিন বক্তৃতা দিয়েছিলাম, আজ ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা না হলে ভাষা অন্দোলন তো বটেই, ভবিষ্যতে কোনো আন্দোলকেই ১৪৪ ধারা ভেঙে এগিয়ে নেয়া যাবে না। বিক্ষুব্ধ দীর্ঘপথ পার হয়ে আন্দোলন বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এখন পিছিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। আমি সমবেত ছাত্রদের কাছে প্রশ্ন করি, আমরা কি তাহলে ১৪৪ ধারার ভয়ে পিছিয়ে যাবো? জবাবে সবাই সমস্বরে উত্তেজিত কন্ঠে উচ্চরণ করে ‘না, না। ’ তখন আমি বললাম ‘দশজন করে করে এক লাইনে দাঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ’ তবে এ ভাবনা শুধু আমার একার ছিল না। মোহাম্মদ তোয়াহ ও আবদুস সামাদ আজাদসহ একত্রে মিলে নিয়েছিলাম। ছাত্র-জনতার বিজয় কেউ ঠেকাতে পারে? ভাষা অন্দোলন এক নতুন মাত্রা পেল। কিন্তু পুলিশ গুলি চালালে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন, আব্দুল জব্বার শহীদ এবং অন্য অসংখ্য মানুষ আহত হয়।

ভাসানী আপনার প্রিয় নেতা, তার সম্পর্কে কিছু বলবেন?

ভাসানীর মতো নেতা এখন আর কোথায় পাবে? সে তো যুগে যুগে দু’একজন আসে পৃথিবীতে। এমন মাটির মানুষ আর চোখে দেখলাম না। সারাটা জীবন যেন মাটির মতোই থেকে গেল। কোনো স্বার্থ তাকে স্পর্শ করতে পারলো না। এমন মানুষ কোথায় পাবো? বড় দরকার ছিল এমন মানুষের। বঙ্গবন্ধুও তাকে চিনতে পারলো না। এ দেশের বামরাজনীতির পুরোধা এই ব্যক্তি আমাদের দিয়েছেন মুক্তির মন্ত্রণা আর পথ চলার সাহস।

মোট কতবার আপনাকে গ্রেফতার করা হয়? এবং জীবনের কতবছর আপনাকে জেল খাটতে হয়েছে?

পাঁচবার আমাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়েছে। প্রথমবার গ্রেফতার করে ১৯৪৯ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ববেতনভুক্ত কর্মচারিরা ধর্মঘট করে, সেখানে আমি তাদের সমর্থনে পিকেটিং করেছিলাম। পুলিশ সচিবালয়ের গেটে থেকে ধরে দু’মাসের ডিটেনশন দেয়। দ্বিতীয়বার ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে শান্তিনগর কমিটির মিটিং ডাকা হয়। ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’ পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত  গৃহীত হয়। ২৮ ফেব্রয়ারি ১৯৫২ সালে আমার নামসহ বহু নেতার নামে গ্রেফতারি পরয়ানা জারি করা হয়। আটক হয় আবুল হাশিম, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, আব্দুল রশীদ তর্কবাগীশ, ওসমান আলী, মাদার বক্স, মুনীর চৌধুরী, অজিত কুমার গুহ, মুজাফফার আহমদ চৌধুরী, পুলিন দে, ড. পিসি চক্রবর্তী, ডা. আজমত আলী, খয়রাত হোসেন, গোবিন্দ লাল মুখার্জি, মির্জা গোলাম হাফিজ, মোহাম্মদ তোয়াহ, আজিজ আহম্মদ, অলি আহাদ, এসএ বারী এটি, খালেদ নেওয়াজ, শওকত আলী, হাশিমুদ্দিন আহমদ, ফজলুল করিম, অনোয়ারুল হক, সাদেক খান, লতিফ চৌধুরী, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী, মজিবুল হক, হাসান পারভেজসহ আরো অনেকে। সেবার ১ বছর সাত দিন জেলে থেকে ১৪ মার্চ ১৯৫৩ সালে মুক্তিলাভ করি। তৃতীয়বার গ্রেফতার হই ঈশ্বরদীতে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা অবস্থায়। সেবার সরকার আমাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ হাজার টাকা ঘোষণা করে। চতুর্থবার ধরা পড়ি ১৯৭২ সালের ৫ জুন, নাটোর থেকে। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পেয়ে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হই।   তারপর আবার শেষবার ধরা পড়ি এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ সালে। সবমিলে পাঁচবার গ্রেফতার হয়ে প্রায় দশ বছর জেল খেটেছি।  

যে বাড়িতে আছেন এখন, এটা আপনার নিজের বাড়ি?

না এটা আমার না। ভাড়া বাড়ি। আমার কোনো বাড়ি নেই। নিজের বাড়ি কোথায় পাবো? আমার কি এতো টাকা আছে যে ঢাকা শহরে বাড়ি থাকবে।

শুনেছি সরকার নাকি আপনাকে পুরান ঢাকায় একটা বাড়ি দিয়েছেন তাহলে এখনো এই ভাড়া বাড়িতে থাকেন কেন?

আমি তো আমার আদর্শ থেকে একচুলও নড়তে পারবো না। সরকার আমাকে বাড়ি দিয়েছে ঠিক, কিন্তু সেটা নাকি কারা দখল করে আছে তাদেরকে হটিয়ে সেখানে আমাকে উঠতে হবে। কী তামাশার ব্যাপার! সেখানে লোক পাঠানো হয়েছিল এক হিন্দু বয়স্ক মহিলা রান্নাঘর থেকে বটি বের করে বলেছে ‘কারা এসেছে আমার বাড়ি দখল করতে? আসুক না আমার সামনে খুন করে ফেলব সবগুলোকে। ’ ভয়ে বেচারা চলে এসে নিজের জীবন বাঁচিয়েছে আর কি। সেই মহিলার তিনকূলে কেউ নেই।

এসময় ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের স্ত্রী মনিকা বলেন ওগুলো আর বলো না বাবা। সব দল তাকে ডেকেছে। কোনো দলের হয়ে সাফাই গাইতে পারেনি বলে তারাও আর দেখেনি আমাদের। শেখ মুজিব - জিয়া সবাই এসেছে তার কাছে। সেখানে গিয়ে শেখ মুজিব আর মেজর জিয়ার গুনগান গাইতে হবে; এসব আমাদের ভালো লাগে না। গাইতে পারলে মতিন সব পেতো, গায়নি বলে পেল না কিছুই।

আবার ফিরি আব্দুল মতিনের কাছে:

বায়ান্নতে আপনার বয়স ২৫ বছর। বাঙালি ও বাঙলা ভাষার ইতিহাসে সবচেয়ে সাহসী ও রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ছিল ৫২’র ভাষা আন্দেলন। কথা হচ্ছে একুশে পদক পেয়েছেন ২০০২ সালে। এত দেরির কারণ জানতে পারি?

কারণ কী করে জানবো? কারণ তো তোমরা দেশের মানুষ জানো। দেখো কমরেড, আমি কারও দালালি করতে পারিনি কখনো। সেখানেই যত মুশকিল। হয়তো সেজন্যে এতো বছর পরে এটা পেলাম তাও তো বিদেশ থেকে একটি সংগঠন জোর দাবি তুলেছিল বলেই যে, এতো বছর পরেও কেন ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনকে একুশে পদক দেয়া হচ্ছে না। তখন হাসিনা সরকার ক্ষমতায় ছিল কিন্তু পরে এসে খালেদা সরকার একুশে পদক দেয়। বোধ হয় চাপে পড়ে এটা করেছে। যাই হোক ওসব কথা থাক। পদকের জন্যে তো আর কিছু করিনি, করেছি মাতৃভাষা আর মাতৃভূমির ভালোবাসায়। এগুলো আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিল, আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি এখন তোমাদের দায়িত্ব তোমরা কী করবা সেটা তোমরাই জানো। দেশপ্রেম একটা আলাদা জিনিস এটা থেকে কেউ বের হতে পারে না। কিন্তু কে কতটুকু করতে পারে এটাই আসল কথা।

ছবিতে দেখেছি আপনি চীন ও আমেরিকা ঘুরে এসেছেন কিভাবে গেলেন সেখানে বিদেশ ঘুরতে এতো টাকা কোথায় পেলেন?

১৯৮২ সালে আমি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন সফরে যাই। চীনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো ঘুরে দেখি। সেখানে আমার হার্টের অপারেশন করানো হয়। তারপর ২০০০ সালে প্রবাসী বাঙালিদের আমন্ত্রণে আমেরিকায় যাই। সেখানে প্রবাসীরা মিলে ‘ঐতিহাসিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন করেন। সেখানে আমি চার মাস থেকেছি। আমেরিকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঘুরে দেখি। এবং প্রবাসী বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি।

আপনি ভাষা অন্দোলন ছাড়াও কৃষক অন্দোলন, বাম অন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সে সম্পর্কে কিছু বলবেন?

১৯৭৭ সালে জেল থেকে বের হয়ে আমি চারু মজুমদারের দল ত্যাগ করে কৃষকদের নিয়ে ‘চাষী মুক্তি সমিতি’ গঠন করি। পরে ‘চাষী মুক্তি সমিতি’, ‘কৃষক ফেডারেশন’, ও ‘কৃষক সংগ্রাম সমিতি’ ঐক্যবদ্ধ হয়। পাবনা জেলার বেড়া থানার প্রায় বিশ হাজার কৃষকের উপস্থিতিতে ‘জাতীয় কৃষক সমিতি’ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। সমিতির সভাপতি ছিলাম আমি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিমল বিশ্বাস।

সারাটা জীবন এসব আন্দোলন সংগ্রামের পিছনে ব্যয় করলেন, জীবন সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?

জীবন এক বিচিত্র রঙের বাহার। সাদা কালো নীল যেমন আমাদের মনের পর্দায় উঁকি মারে ঠিক তেমনি দুঃখ কষ্ট সুখ সবকিছু মিলেই তো জীবন। কষ্টের মাত্রা যার জীবনে যত বেশি, সে তত বেশি খাঁটি মানুষ হতে পারে। জীবন মানে অভিজ্ঞতা। যার জীবনে অভিজ্ঞতা নেই, সে জীবনের মানেই জানে না।   সাঁতার না জানা বালকের জীবন তো আর গুলতি নিয়ে পাখি মারা বালকের জীবনের মতো হতে পারে না। মূলত দুঃখই মানুষকে মানুষ হতে সাহায্য করে। আর সুখ তো নিজস্ব ব্যাপার। নিজেই মনেই তৈরি করে নিতে হয় সুখ। এই যে ভালোবাসা। আমি কি কোনোকালে ভেবেছি এতো বুড়ো বয়সে আমি তোমার মতো তরুণের মুখোমুখি বসে জীবনের গল্প বলবো। আমার খুব ভালো লাগছে। এটাই তো সুখ। কেউ আসে না। বন্ধুরা সবাই তো চলে গেছে। যারা আছে তারা চলতে পারে না। আর সারাজীবনে যত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি তা তো দশজীবনে শোধ করতে পারবো না। আসলে আমাদের সকলকে ভালোবাসা উচিত। কি শত্রু কি মিত্র, মানুষের উচিত মানুষের জন্য সংগ্রাম করা।

গুলবদন নেছা মনিকার সঙ্গে আপনার বিয়ের গল্পটা শুনতে চাই।

আমি তখন পার্টি করি। সারারাত সারাদিন শুধু পার্টি করে বেড়াই। আমার বয়স তখন চল্লিশ। আর মনিকার বয়স বিশ। একদিন আমার পার্টির লোকেরা ধরলো মতিন ভাই আপনাকে বিয়ে করতে হবে। আমি তো সংসারী মানুষ না। সারা জীবন যে বাইরে বাইরে কাটিয়ে দিলো, ভেতর কি তাকে টানে? আমি বললাম তাহলে মেয়েটা কে? আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। ওরা বললো কথা অবশ্যই বলা যাবে। তারা বললো আমাদের পার্টির মেয়ে, নাম মনিকা। ঠিক আছে, আমার সাথে দেখা করতে বলো। মনিকা এলো আমার সাথে দেখা করতে। তাকে বললাম দেখো আমি পার্টি করি সংসার দেখা ছেলেময়ে মানুষ করাসহ যাবতীয় ঝামেলা তোমাকে পোহাতে হবে। আমি এদিকে মাথা ঘামাতে পারবো না। শুনে মনিকা বললো এসব আমি কিছু জানি না, আমার বড় ভাই আছে সে যদি অনুমতি দেয় আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি আর কোনো কথা বললাম না। খানিক রাগ হলো। আমি যাকে বিয়ে করবো সে বলে ভাইয়ের কথা। তার মানে সে আমাকে পছন্দ করে না। যাই হোক এভাবে আমাদের বিয়ে হলো। বিয়ের আগে আমাদের পরিচয় বা কোনো সম্পর্ক ছিল না।

এসময় মনিকা বললেন, আমি তাকে মাঝে মাঝে দেখতাম, কথা হতো না। তিনি তো তখন সিনিয়র লিডার। নাম শুনতাম ভাষা সৈনিক। এটুকুই।

বিপ্লবীরা নাকি ভালো প্রেমিকও হন। আপনি কি কখনো কারো প্রেমে পড়েছেন? কিংবা আপনার প্রেমে কেউ?

একবার একটি মেয়ে আমার প্রেমে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক হয়নি। কারণ আমি আসলে ঘর সংসার করতে চাইনি। আমি সারা জীবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত সময় পার করেছি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কম মেয়েই লেখাপড়া করতো। তারমধ্যে একজন আমাকে পছন্দ করতো। সে আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও ছিল। তার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হতো।

তার নামটা শুনতে পারি?

তার নাম আমার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে শুরু। মালেকা। বিএ ক্লাসের ছাত্রী ছিল। প্রায় দু’তিন বছর আমার পেছনে লেগে ছিল। প্রেম-ট্রেম নিয়ে তখন আমার ভাবার সময় কোথায়?

২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি বাংলায় ৮ই ফাল্গুন, ভাষার জন্য অর্জিত এ দিবসটিকে কেন আমরা ২১ ফেব্রুয়ারি হিসেবেই পালন করি? এটা কি স্ববিরোধিতা নয়?

হ্যাঁ এটা অবশ্যই স্ববিরোধিতা। এটা নিয়ে অনেক বলা হয়েছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। দেখো, শাসক শ্রেণি দেশপ্রেমিক না হলে এমনই অবস্থা হয়। কারো কোনো দায়বোধ নেই। কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই। যে যার মতো করে চালিয়ে নিচ্ছে নিজের স্বার্থের চাকা। এভাবে কি একটা দেশ চলতে পারে? কী আর করার! আমাদের কাজ আমাদের করতে হবে। একদিন ঠিকই এই জাতিকে তার ভুলের খেসারাত দিতে হবে। নামমাত্র মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে চলছে ব্যবসা। কাজের কাজ হয়নি কিছুই। বিনা চিকিৎসায় মরে যাচ্ছে মানুষ। অনাহারে দিন কাটাচ্ছে অসংখ্য লোক। সেখানে স্বাধীনতার স্বার্থকতা কোথায়? স্বাধীনতার তো মানুষের মৌলিক চাহিদার যোগান দেয়ার কথা!  

বাংলাদেশে এখনো সর্বপর্যায়ে বাংলাভাষা চালু হয়নি। আপনার অভিমত কী?

সেটা তো আগের প্রশ্নের সাথে জড়িত। ভাষার জন্যে লড়াই হলো জীবন গেল রক্ত গেল অথচ তার মূল বিষয়টাই রাজনীতিবিদরা এড়িয়ে চলেন। ভাষাশহীদদের স্মৃতি রক্ষায়ও কোনো ধরনের মনোযোগ লক্ষ্য করা যায়নি। তাদের নামে যে জাদুঘরগুলো আছে সেগুলো একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

কমরেড আব্দুল মতিন আর ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের মধ্যে পার্থক্য কী?

এটা তো তুমি এখন পার্থক্য করতে পারো। আমার কাছে যারা এসেছে তারা পারে। আমি নিজেকে কিভাবে পার্থক্য করবো! তবে এটুকু বলতে পারি, কমরেড আব্দুল মতিন এখনো মনেপ্রাণে একজন কর্মীমাত্র। আর ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন মাতৃভাষার প্রেমে গর্জে ওঠা সংগ্রামী এক তরুণ। নিজের ভাষার জন্য যে জীবন বাজি ধরে আন্দোলন করে গেছে।

বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পাবার উপায় কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়া কোনো জাতির ভাগ্য বদল হয় না। আমরা অন্দোলন সংগ্রাম ভুলে যাচ্ছি। যে যেভাবে ইচ্ছা আমাদের শোষণ করছে। নিজেদের স্বার্থের ভয়ে আমার পথে নামি না। নেতারা দেশপ্রেমিক না হলে এসব আমাদের সাফার করতে হবে। সৎসাহসী মানুষের বড় অভাব সমাজে।

আপনার প্রিয় একটি বাক্য বলুন।

এ সমাজে যেন মানুষের কোনো মূল্য নেই। অনেকের কাছে মানুষ যেন মূল্যহীন। কিন্তু আমার কাছে মানুষই সবচেয়ে প্রিয়।

মৃত্যু নিয়ে আপনার মধ্যে কোনো ভীতি কাজ করে?

পরকাল আছে কি নেই, এ ভাবনা ভাবার কী দরকার? মৃত্যু সেটা তো স্বাভাবিক ঘটনা, অনিবার্য। মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো ভীতি নেই। আমি লোক দেখানোর জন্য কিছু করি না। আমি তুচ্ছ কারণে হাসি। মানুষ মাত্রই আমার ভালো লাগে। শেষ বয়সে এসে বুঝি মানুষের গোটা জীবনটাই উপভোগ্য। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা-রেষারেষি বোকামি। যখন সমাজে ধর্মই প্রধান হয় তখন এমনটা ঘটে। আমাদের বুদ্ধি আছে জ্ঞান নেই, জ্ঞানহীন বুদ্ধি কোনো কাজে লাগে না।

এখন আপনাদের সময় কাটে কিভাবে?

সময় তো সময়ের মতো কেটে নিয়ে যাচ্ছে জীবন। আমরা আছি সময়ের গতরে নিষফোঁড়া হয়ে।

স্ত্রী মনিকা বললেন, এই তো এখনো বই পড়ি। খাই দাই ঘুমাই। গল্প করি। নাতনি আছে ওর সাথে খেলাধূলা করি। চোখে দেখি কানে শুনি তাই বই পড়ি পত্রিকা পড়ি। এভাবে সময় চলে যাচ্ছে। সে তো যাবার জিনিস, যাবেই। আটকে রাখা যাবে না।

আপনার ছেলে-মেয়ে কয়জন? তারা কোথায় কী করছে?

আমারদের কোনো ছেলে নেই। মেয়ে আছে দুই জন। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। একজন আমাদের কাছে থাকে। বড় মেয়ে মাতিয়া বানু শুকু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে বের হয়ে নাটক লেখে ও পরিচালনা করে। উত্তরায় ওদের বাসা। মাঝে মাঝে আসে বেড়াতে। আসতে না পারলেও ফোনে খবর রাখে। ওর তিন ছেলে। জামাই নাট্যকার নূরুল আলম আতিক। আর ছোটমেয়ে মালিহা শোভন। সানিডেল নামে একটা বেসরকারি স্কুলে টিচার হিসেবে আছে। ওর একটা মেয়ে। ওরা দুজনে একত্রে স্কুলে যায়। ওরা আমাদের সাথেই থাকে। জামাই সাভারে একটা ব্যবসা করে। ও আমাদের ছেলের মতো। এখন সবকিছু ও-ই দেখাশোনা করে।

আপনার জীবনে স্ত্রী মনিকার অবদান কতটুকু?

মনিকাই তো আমার সবকিছু আগলে রেখেছে। দুজনই একসাথে পার্টি করেছি। তাকে তো বলেই ছিলাম যে সংসার-ধর্ম তাকে দেখতে হবে, সে তার দায়িত্ব পালন করেছে। কোথাও তার কোনো ত্রুটি আমি দেখিনি কখনো। এই দেখছো না আমাকে কেমন শিশুর মতো আগলে রেখেছে। নারীরা তো শীতল ছায়ার মতো। তাছাড়া একজন মানুষকে নিয়ে দু’এক কথা বলে শেষ করা যায় না। মনিকার কথা মনেই থাক। মনিকা তো মনিকাই। জীবনে যে নারীরা এতো কষ্ট করতে পারে তা মনিকাকে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আমি তো জেলে জেলে ছিলাম, অনেক কষ্টে একা একা ছেলে মেয়েদের মানুষ করেছে সে।

আপনার নাকি অনেকগুলো ডাকনাম আছে। একটা মানুষের অনেকগুলো ডাকনামের রহস্য কী!

বাবা আদর করে ডাকতো ‘গেদু’ বলে। মামাবাড়িতে রাব্বানী বলে ডাকা হতো। দার্জিলিং হাইস্কুলে সবাই ডাকতো ‘মার্টিন’ নামে। পরে আমার বাবা এক সময় ব্যবসা করতে গিয়ে সে প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘মার্টিন ব্রাদার্স’। পাবনায় পরিচিত ছিলাম ‘ছাত্র মতিন’ নামে। আরা সারা দেশের মানুষ তো চেনে ভাষা মতিন নামে। আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনে পার্টির কমরেডরা ‘দিঘু’ নামে ডাকতেন। জেল থেকে বউয়ের কাছে চিঠি লিখতাম ‘পিরু’ ছন্মনামে। এ সব ছন্মনাম তো ইচ্ছে করে দিইনি। সময়ের প্রয়োজনে তৈরি হয়ে গেছে।

৮ বছর বয়সে আপনার মা অ্যাকলেমশিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মায়ের কোনো স্মৃতি মনে আছে?

নক্ষত্র পতনের মতো মা চলে গেলেন। আমরা পাঁচ-পাঁচটি অবুঝ ভাই-বোন। মা যখন মরে গেলেন তখন ছোটভাই পটুর বয়স মাত্র সাত দিন। এক নেপালী দাইমা তাকে ছয়মাস লালন পালন করে, কিন্তু পটুর অকাল মৃত্যু হয়। মা মারার পর কোনো দিন টিফিন খেতে পারিনি। এমনকি একটা চিনাবাদামও না। স্কুল থেকে ফিরে নিজে আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে খেতাম। বাবার চাকরি জীবনে প্রথম দিকে তিনবেলা খাবার জুটতো না। প্রতিদিন পেঁয়াজ ভাজা দিয়ে ভাত খেতে হতো।

আপনি নাকি সৎ মাকে মা বলে ডাকতেন না?

সৎ মাকে মা ডাকলে আমার আপন মায়ের মুখচ্ছবি মনের পর্দায় ভেসে উঠতো। একদিন বাবা বিষয়টা খেয়াল করে আমাকে হুঁকোর নল দিয়ে খুব পেটালেন। আমি খুব জেদি আর একরোখা ছিলাম। একফোঁটা পানিও চোখ দিয়ে বের হয়নি। একটুও আহ উহু করিনি। পরে অবশ্য সৎ মায়ের সঙ্গে আমার আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়। এরপর কখনো কোনো ধরনের মনোমানিল্য হয়নি।

১৯৩০ সালে আপনাদের বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে যায়, তখন আপনার বাবা দার্জিলিং চলে যান। সেসব ভাঙনের স্মৃতি মনে আছে?

মনে আছে। যে বার আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে গেল নদীর জলে, তখন আমার বয়স মাত্র চার বছর। কিছু কিছু মনে তো আছেই। কয়েকবার সেখানে গিয়েছি। আর দীর্ঘশ্বাস জমা রেখে এসেছি। কী আর করা, নদী তো আর কারো শাসন-বারণ মানে না। সে তো তার নিজের গতিতে চলবে। তাই না? তবে হ্যাঁ, জীবনে কিছু ট্র্যাজেডির দরকার। যাদের ঘর নদীতে ভাঙেনি তাকে কি কখনো নদীভাঙনের কষ্ট বলে বোঝানো যাবে? অভিজ্ঞতা এক ভিন্ন জগত।

আপনার শৈশব ও লেখাপড়ার হাতেখড়ি শিলিগুড়িতে। সেখানকার কোনো স্মৃতি আপনার অতীতকে টানে?

হ্যাঁ টানবে না কেন। অতীত স্মৃতি কেউ কি ভুলে যায়! ওখানেই তো আমার জীবনের শুরু। বাড়িঘর হারা আমার বাবা তখন দিশেহারা। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েই তো আমরা নতুন জীবন শুরু করতে পেরেছিলাম। আমার বাবা দার্জিলিং জলাপাহার ক্যন্টনমেন্ট এলেন। সেখানে ইংরেজ সৈন্যরা থাকতো। একটি ফ্যামিলি ব্যারাক ছিল সেখানে। আর ব্যারাকের পাশে বড় একটা মনোরম ফুলের বাগান। ১৯৩২ সালে ফেব্রয়ারি মাসের দিকে আমি মা বোন-ভাইসহ দেশ থেকে গিয়ে সেখানে উঠেছিলাম। এর কয়েকদিন পর ৩ মার্চ দার্জিলিং শহরের (ছেলেদেরও ফোর পর্যন্ত পড়ানো হতো) একটা গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম, তা এখনো মনে আছে। সেসব মনোরম পরিবেশের কথা এখনো মনে পড়ে। দার্জিলিংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনো তুলনা নেই। বাবার সাথে টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখতে যেতাম। বাসা থেকে মাঠে গেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার সূর্য চিকচিক করতো। কী অপূর্ব দৃশ্য! শীতকালে দাজিংলিয়ে গরম পানি ছাড়া গোসল করা যেত না।

আপনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্যে ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলেন ভারতে, যুদ্ধে অবশ্য যেতে পারেননি শেষ পর্যন্ত। সে সময়ের কোনো স্মৃতি বলবেন?

হ্যাঁ আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে ট্রেনিংও করেছিলাম। তখন আমি রাজশাহী কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। এক বন্ধু আর আমি, আমরা ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। এক আর্মি আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো এখানে কী করতে এসেছি। বললাম বেড়াতে। তিনি বললেন তুমি তো বেশ মরদ। ইচ্ছে করলে ট্রেনিংয়েও যেতে পারো। আমি সায় দিলাম। তারা আমার মাপ নিলো। প্রাথমিকভাবে আমাকে বাছাই করে কলকাতা পাঠিয়ে দেয়া হলো। আমাকে বললো, একা একা যেতে হবে। তুমি যেতে পারবে তো? আমি বললাম আমি পারবো। আমাকে ঠিকানা দেয়া হলো। সেখানে গিয়ে শুনি যুদ্ধ নাকি শেষ। তারা আমাকে বললো এসেছো যখন ঘুরে যাও কিছুদিন। আমাকে তখনকার দিনে ৬০ হাজার টাকাও দিলো। আমি অবাক হয়ে বললাম এতো টাকা কেন? তারা বললো এটা দিয়ে তুমি ভারতে ঘুরবা আর বাড়ি যাবার খরচ লাগবে না? আমি সারা ভারত ঘুরলাম। বোম্বে, দিল্লি, তাজমহল, খাজা মইনউদ্দিন চিশতীর আজমীর শরীফ এসব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তারপর চলে আসি দেশে। আমাকে তারা একটি সার্টিফিকেট দিয়েছিল।

শুনেছি আপনি সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন, কিন্তু করেননি। কেন?

প্রলোভনে পড়ে বৃত্তি নিয়ে বা সিভিল সার্জনে চাকরিতে জয়েন করলে ভাষা আন্দোলনের মতো মহান আন্দোলনের অংশীদার হয়ে যেটুকু ভূমিকা পালন করেছি, তা থেকে বঞ্চিত হতাম। চাকরি দিয়ে শুধু নিজের জীবন গোছানো যায়, অন্যের ভাবনা ভাববো কখন? সরকারি চাকরি করলে কোনো আন্দোলন সংগঠন করা যায় না। চাকর হওয়া কি সবার পক্ষে সম্ভব? নিজের জন্য করে কি আনন্দ পাওয়া যায়? যারা পায় তারা পাক। তাছাড়া চাকরি দিয়ে নিজের ভাগ্য বদল করা যায়, জাতির ভাগ্য বদল করা যায় না। একটাইতো জীবন। সংগ্রাম না থাকলে সে জীবনের কোনো মূল্য আছে? অন্যের কাছে থাকতে পারে আমার কাছে তার কোনো মূল্য নেই।

এতো ব্যস্ততা সংগ্রামের মধ্যেও আপনি অনেকগুলো বই লিখেছেন। লেখক আব্দুল মতিনের সৃষ্টি হলো কিভাবে?

আমি যখন ভাষা আন্দোলন করলাম, পরক্ষণে আমার মনে হলো এসব বিষয় লিখে রাখা বোধ হয় খুব বেশি দরকার। একটা জাতির মুক্তির জন্যে তো আগে সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রয়োজন। আমরা তা এখনো করতে পারিনি। বিদেশী সংস্কৃতি আমাদের ঘরে বাইরে এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে আমরা এখন সাংস্কৃতিকভাবে দেউলিয়া হতে বসেছি। এতো নোংরামি দেখতে হবে জীবনে তা ভাবতে পারিনি। প্রগতি মানে বেহায়াপনা না। গতি মানে অবক্ষয় না। নিজেদের শিকড় ভুলে গেলে সে জাতির ভাগ্য বড়ই শোচনীয়। আমাদের সাংস্কৃতিক মুক্তি দরকার। লিখেছি আমার জীবন নিয়ে ‘জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে। ’ এছাড়া আরোও অনেক বই আছে। গণচীনের উৎপাদন ব্যবস্থা ও দায়িত্ব প্রথা, ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য, আব্দুল মতিন ও আহমদ রফিক, বাঙালী জাতির উৎস সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি।

আপনি কি কখনো কবিতা লিখেছেন?

একটি কবিতা লিখেছিলাম তার নাম ‘বাস্তবতা মহান শিক্ষক’। আর দুটি ছড়া আছে লেখা। একটি ছড়ার নাম ‘লেখাপড়া’ আর ১৯৪৭ সালে জেলখানায় বসে বড় মেয়ে মাতিয়া বানু শুকুকে উদ্দেশ্য করে ‘কোকো মণি’ নামে একটা ছড়া লিখেছিলাম। লেখাটি স্ত্রী মনিকা অনুলিপি করে রেখেছেন আজও।

আপনি কি কখনো কবিতা লিখেছেন?

একটি কবিতা লিখেছিলাম তার নাম ‘বাস্তবতা মহান শিক্ষক’। আর দুটি ছড়া আছে লেখা। একটি ছড়ার নাম ‘লেখাপড়া’ আর ১৯৪৭ সালে জেলখানায় বসে বড় মেয়ে মাতিয়া বানু শুকুকে উদ্দেশ্য করে ‘কোকো মণি’ নামে একটা ছড়া লিখেছিলাম। লেখাটি স্ত্রী মনিকা অনুলিপি করে রেখেছেন আজও।

আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও ভালোবাসা।

লাল সালাম কমরেড!

বাংলাদেশ সময়: ১৮০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad