ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

কক্সবাজার সৈকতে ফের শামুকের মৃত্যুর মিছিল

কামরুল ইসলাম মিন্টু, অতিথি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১১
কক্সবাজার সৈকতে ফের শামুকের মৃত্যুর মিছিল

কক্সবাজার: বঙ্গোপসাগরে আবারও শামুক-ঝিনুকের মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে ভেসে আসছে লাখ লাখ মৃত শামুক ও ঝিনুক।



এসব শামুকের দুর্গন্ধে পরিবেশ দূষিত হওয়ার পাশাপাশি নানা দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পর্যটকসহ স্থানীয় লোকজনের।

সরেজমিন দেখা যায়, কক্সবাজার উপকূলের নাজিরার টেক থেকে শৈবাল পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার সৈকত জুড়ে মৃত শামুকের খোলস পড়ে আছে।

স্থানীয় নাজিরার টেক এলাকার বাসিন্দা আবুল বশর ও জেলে ছৈয়দ আকবর বাংলানিউজকে জানান, প্রতিদিন সৈকতে অসংখ্য মৃত শামুক ও ঝিনুক জোয়ারের পানিতে ভেসে আসছে। পঁচা ঝিনুক ও শামুকের তীব্র দুর্গন্ধে সৈকতের পরিবেশ হয়ে উঠেছে অস্বাস্থ্যকর।

কক্সবাজার পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বাংলানিউজকে জানান, গত মার্চ মাসের শেষ দিকে বঙ্গোপসাগর থেকে মৃত শামুক ভেসে আসতে শুরু করে। মাঝে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও আবার শামুক ভেসে আসতে শুরু করেছে।

এদিকে, কয়েকদিন ধরে হঠাৎ করে এভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে শামুক-ঝিনুক ভেসে আসার পেছনে বঙ্গোপসাগরে পরিবেশগত অথবা ভূমিক¤পজনিত কোনো বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চিফ সাইন্টিফিক অফিসার ড. সাহাব উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, ২০০২-০৩ সালের দিকেও একবার ব্যাপক হারে এ রকম মৃত শামুক-ঝিনুক সাগরতীরে উঠে এসেছিল। এসব জীববৈচিত্র কুড়িয়ে নিলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। এর আগে ১৯৯৮ সালের দিকে একবার সাগরের তলদেশে ভূমিকম্পের সময়ও ব্যাপক হারে সামুদ্রিক জীব সৈকতে উঠে এসেছিল।

তিনি আরও বলেন, সমুদ্র দূষণের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। এছাড়া সাগরে লবণের মাত্রা বৃদ্ধি, খাদ্য সংকট, আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলেও সামুদ্রিক জীব মারা যেতে পারে। সমুদ্র উপকূল জুড়ে দূষণের ফলে ইলিশসহ সামুদ্রিক মৎস্যের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হুমকির মুখে এখন সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র্য।

প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হওয়ায় বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছের মধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর বিলুপ্তির পথে রয়েছে ইলিশ, লইট্ট্যা, গোঁফা ও কোরালসহ কয়েক প্রজাতির মাছ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলানিউজকে জানান, মাছ ধরার যান্ত্রিক নৌকা এবং মালবাহি জাহাজ থেকে ফেলা বর্জ্যের কারণে সাগর দূষিত হচ্ছে সব চেয়ে বেশি। সাগরে ৩০ হাজারের বেশি ফিশিং বোট রয়েছে। যার মাধ্যমে সমুদ্র দূষণ হচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে।

তিনি আর বলেন, বন্দর ব্যবহারকারী জাহাজগুলো সমুদ্রে বর্জ্য ফেলছে প্রতিনিয়ত। এছাড়া বিভিন্ন নদী মোহনায় রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় ডকইয়ার্ড। এখানে মাছ ধরার নৌকা ও ইঞ্জিন সার্ভিসিং করে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সমুদ্রে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে শুধুমাত্র কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী মোহনায় রয়েছে শতাধিক ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ডের বৈধ কোন অনুমোদনও নেই বলে জানান আব্দুল্লাহ আল মামুন।

বেসরকারি সংস্থা কক্সবাজার পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সূত্র জানিয়েছে, সমুদ্র উপকূল জুড়ে তেল জাতীয় পদার্থের কারণে দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এখানে প্রতি লিটার পানিতে ১০০ থেকে ১৩০ মিলি গ্রাম পর্যন্ত তেল জাতীয় পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী মোহনায় এই মাত্রা আরও বেশি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতি লিটার পানিতে ২০ মিলি গ্রাম তেল জাতীয় পদার্থের উপস্থিতি থাকলে তা সাধারণ সহনীয় মাত্রা বলে গণ্য করা হয়। এর ওপরে গেলেই দূষণের পর্যায়ে চলে যায়। দূষণের কারণে শামুক মারা যাচ্ছে, এমনটাই বিশ্বাস বিশেষজ্ঞদের।

তবে কেউই এর সুনির্দিষ্ট কারণ জানাতে পারেনি।
 
এদিকে, স্থানীয় লোকজন তীরে আসা জীবিত ও মৃত শামুক কুড়িয়ে ঝাড়বাতি, চুরি, মালা, কানের দুলসহ নানা ধরনের সৌখিন বস্তু তৈরি করে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করছেন। আবার ভ্রমণে আসা পর্যটকরাও শখের বশে সাগর তীরের এসব শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে নিচ্ছেন। এছাড়া অনেকে ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতল, চিপস-বিস্কুটসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেট সৈকতে ফেলে পরিবেশ দূষণ করছে।

স্থানীয় অনেক শিশু খেলার ছলে সৈকতের লাল কাঁকড়া ধরে ধরে মেরে ফেলে।  

সমুদ্র তীরের পাথর, প্রবাল, লাল কাকড়া, শামুক ও ঝিনুকসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক জীব আহরণ বাস্তুতন্ত্রের জন্য হুমকি স্বরুপ। যা আমাদের অনেকেই জানিনা, আবার জেনেও অনেকে মানিনা।

কেউ যদি শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি বস্তু না কেনে তাহলে এর আহরণ কম হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এতে সাময়িকভাবে স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমাদের দেশসহ সারা বিশ্ব পরিবেশ উপকৃত হবে। এছাড়া বর্জ্য সমুদ্র গর্ভে না ফেলে শোধনের ব্যবস্থা করা উচিত। যা সরকার ও জনগনের যৌথ উদ্যোগে করা সম্ভব।

সর্বোপরি আমাদের সবারই উচিত সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসা।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।