ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

জালে ইলিশ নেই, জেলের মনে সুখ নেই 

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৮
জালে ইলিশ নেই, জেলের মনে সুখ নেই  আমতলী ঘাটে সারিবদ্ধ জেলেদের নৌকা। ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম

চাঁদপুর থেকে ফিরে: তখন ভর দুপুর। চাঁদপুর জেলা শহর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা যোগে ঘণ্টা খানেকের পথ পাড়ি দেওয়ার পর আমরা পৌঁছাই হাইমচর উপজেলার আলগী বাজারে। ওই উপজেলার স্থানীয় সাংবাদিক মো. মোহসিন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মোটরসাইকেলে পুরো হাইমচর ঘুরে দেখাবেন তিনি।

কথামতো প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেলেন আমতলী ঘাটে। মেঘনার ওপারে গাজীপুর, নীল কমল ও ৫ নম্বর হাইমচর ইউনিয়নের মানুষগুলো প্রতিদিনকার যাতায়াত এ ঘাট দিয়ে।

শুক্রবার (৭ সেপ্টেম্বর) জুম্মার নামাজের দিন হওয়ায় ঘাটের কর্মযজ্ঞ কিছুটা কম ছিলো। ঘাটে ভিড়ে আছে পারাপারকারী ইঞ্জিনচালিত নৌকা এবং জেলেদের মাছ ধরার নৌকা। ঘাটের খুব কাছে একটা নৌকা রশি দিয়ে গাছের সঙ্গে বাঁধা, সেখানে কিছু জেলেকে কর্মব্যস্ত দেখা গেলো।
হাইমচর উপজেলার কাঁটাখালি মাছ ঘাটে ইলিশ মাছ ধরার জাল মেরামত করছেন এক জেলে।  ।  ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম
কাছে গিয়ে কথা হয় নৌকার মহাজন রাসু মিয়া হাওলাদারের সঙ্গে। তখন তিনি সুই-সুতা দিয়ে জাল মেরামত করছিলেন। কাজের ফাঁকে-ফাঁকেই আলাপ জমে উঠলো। জানতে চাইলাম নদীতে ইলিশ কেমন, দিনে জালে কেমন ধরা পড়ে। রাসু মিয়া জানালেন, নদীতে আগের মতো ইলিশ নেই। জালে ইলিশ আসতে চায় না। সারাদিনে ১০ জনের খোরাকি নৌকার খরচ উঠাতেই হিমশিম খেতে হয়। আক্ষেপ করে রাসু মিয়া জানান, আল্লায় রিজিক তুইল্লা (তুলে) নিছে। একসময় জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়তো, এখন সেই ইলিশ চোখেও পড়ে না। জালে ইলিশ আসে না বলে মনেও সুখ নেই।

স্থানীয় সাংবাদিক মোহসিন ভাই ও আমার সফরসঙ্গী দুলাল তালুকদার নামাজ পড়ে আসার পর আমরা আমতলী ঘাট থেকে রওনা করি চরভৈরবী বাজারের দিকে। মহসিন ভাই জানালেন চর ভৈরবীতে ইলিশ মাছের বড় মোকাম রয়েছে। এখানে বরিশালের অনেক জেলে আছেন। এ চরের সঙ্গে রয়েছে বরিশালের হিজলা এলাকার সীমানা এবং শরীয়তপুরের সীমানা। মনে মনে ভেবে রেখেছি এ মোকামে হয়তো অনেক ইলিশ দেখতে পাবো। সাজানো ইলিশের ছবি তুলবো। কিন্তু দুপুর ২ টার দিকে গিয়ে দেখি দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন।
মাঝ ধরিয়ায় ইলিশ মাছ ধরছে জেলে।  ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম
যেমন হাঁক-ডাক আশা করছিলাম তার ছিটেফোঁটাও নেই। কয়েকটা দোকান খোলা, জেলেরা কেউ এক হালি, কেউ দুই হালি ইলিশ এনেছে আর আড়তে তা নিলামে বিক্রি হচ্ছে। একটা দোকান থেকে শোনা যাচ্ছে ‘এই পাইকার, হালি ১৮শ, ১৮শ ৫০, দুই হাজার। দুই হাজারের বেশি নিলামে না উঠায় শেষ পর্যন্ত এ দামেই একজন কিনে নিলেন।  

জাহাঙ্গীর আলম নামে এক আড়ৎদার বলেন, ‘নদীতে এখন আগের মতো ইলিশ নাই। জেলেদের জালে আগে যে পরিমাণ ইলিশ আসতো তা এখন আর আসে না। তাই মোকামও আগের মতো জমজমাট না। ’ 

মোটরসাইকেলে আরও আধ ঘণ্টার পথ মাড়িয়ে আমরা পৌঁছাই কাঁটাখালি মাছ ঘাট ও লঞ্চঘাটে। তখন বিকেল নামছিল। ঘাটের পাশের মাছের আড়ত লোক শূন্য। নদীর পাড়ে বসে দু’জন জেলে জাল মেরামত করছিল। কথা বলে জানা যায় সকাল থেকেই তারা নদীতে ছিল। দুপুরের খাবারের পর ছেড়া জাল মেরামত করতে করতেই বিশ্রামটা সারছিলেন তারা।  
এক জেলের সঙ্গে আলাপচারিতায় বাংলানিউজের প্রতিবেদক
আফসার উদ্দিন নামে এক জেলে কাছে জানতে চাইলাম জালে কেমন আসছে ইলিশ। তার কপালেও চিন্তার ভাঁজ। বললো আগের মতো নাই। ঠিকমতো নৌকার খরচও উঠে না কোনো কোনো দিন।

চাঁদপুরে মেঘনা নদী এবং জেলার বিভিন্ন মাছ ঘাট ঘুরে দেখা যায় এ ভরা মৌসুমে সারাদিন নদীতে জাল বেয়েও কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাচ্ছেন না জেলেরা। পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছে তাদের।  

এমনও ঘটনা আছে প্রতিদিন জাল, নৌকা ও ট্রলারসহ মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে নদীতে নামলেও ফিরে আসতে হচ্ছে খালি হাতে। কারণ যেটুকু মাছ পাচ্ছেন তা দিয়ে খরচ ওঠে না। এমন পরিস্থিতিতে অনেকের মাছ ধরার আগ্রহও কমে যাচ্ছে। কারণ এনজিও এবং মহাজনদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের বোঝা নিয়ে এ পেশায় টিকে থাকাটা কষ্ট কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভরা মৌসুমে ইলিশ না থাকায় পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে।
হাইমচর উপজেলার কাঁটাখালি এলাকার একটি মাছের মোকাম।  নদীতে মাছ না থাকাও মোকামটি জমে উঠেনি।  ছবি: সোলায়মান হাজারী ডালিম
চরভৈরবী মাছ ঘাটের জেলে আব্বাস উদ্দিন জানান, স্থানীয় এক মহাজনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। ওই টাকা নিয়ে নৌকা মেরামত ও জাল কিনে নদীতে নেমেছেন তিনি। কিন্তু নদীতে মাছের আকাল। দুশ্চিন্তায় তার ঘুম আসে না।  

অন্যদিকে নদীতে ইলিশ তেমন না থাকায় জেলা শহরের বড় রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন মাছের মোকাম, হরিণা ঘাটের মাছের মোকাম, চরভৈরবী ও কাটাখালি এলাকার মাছের আড়তগুলোকেও তেমন জমজমাট মনে হয়নি। অল্প-স্বল্প মাছের কেনা-বেচা হলেও তাতে সন্তুষ্ট নন মোকামের ব্যবসায়ীরা।  

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. ইউসুফ বন্ধুবাসী বাংলানিউজকে বলেন, ‘নদীতে ইলিশ নেই, তাই জেলেরাও কষ্টে আছে। এতে ব্যবসায়ীরাও লোকসানের মুখে আছে। মাছ সংকটের কারণে জেলে আড়ৎদার, পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী সবারই অবস্থা খারাপ। তাই যে পরিমাণ মাছ ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে তা বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ’

বাংলাদেশ সময়: ০২২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৮
এসএইচডি/পিএম/জিপি 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।