ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

অপরিকল্পিত জুমে ধ্বংস পার্বত্য সংরক্ষিত অরণ্য

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০১৭
 অপরিকল্পিত জুমে ধ্বংস পার্বত্য সংরক্ষিত অরণ্য অপরিকল্পিত জুমে ধ্বংস পার্বত্য সংরক্ষিত অরণ্য

২০০০ সালে বনগরু বা গাউরকে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইউসিএন)। কিন্তু দশক পেরিয়ে সেই বিলুপ্ত গাউরের খোঁজ মেলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক পাহাড়ি বনে।

সাঙ্গু মাতামুহুরি রিজার্ভ ফরেস্টে। পাওয়া যায় ছয় প্রজাতির বন বিড়াল।

এর মধ্যে ছিলো চিতা বিড়াল, মেঘলা চিতা, মরমর বিড়াল, চিতাবাঘ।

পাওয়া যায় বাঘের পায়ের ছাপ। পাওয়া গেছে ভাল্লুকের দুই প্রজাতি- সূর্য ভাল্লুক একং কালো ভাল্লুক। বন্য কুকুর, হাতি, দুই প্রজাতির হরিণ, বন্য শূকর, ছয় প্রজাতির বানর, তিন প্রজাতির ধনেশ পাখি, আট প্রজাতির কচ্ছপ, দুই প্রজাতির অজগর সাপের বাস এ বনাঞ্চলে। উপরে উল্লেখিত বন্য প্রজাতিগুলোর মধ্যে দু’একটি বাদে প্রায় সবগুলোই এ দেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।

বিচ্ছিন্নভাবে দু’একটি করে প্রজাতি বাংলাদেশের বিভিন্ন বনে থাকলেও একসঙ্গে এত বন্য প্রাণের উপস্থিতি এ মুহূর্তে আছে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। আরও সংক্ষেপে বললে, এই মুহূর্তে সাঙ্গু মাতামুহুরি, রাইক্ষ্যং এবং কাসালং বনাঞ্চলই হচ্ছে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীকূলের শেষ আবাসস্থল বলা যায়। অপরিকল্পিত জুমে ধ্বংস পার্বত্য সংরক্ষিত অরণ্যকেমন আছে এসব অমূল্য প্রাণের শেষ আশ্রয়স্থলগুলো? পরিসংখ্যান, তথ্য-উপাত্ত আর সরেজমিন পর্যবেক্ষণ বলছে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে এসব পাহাড়ি বনাঞ্চলও ধ্বংসের শেষ সীমায়। ধরা যাক জীববৈচিত্র্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ সাঙ্গু মাতামুহুরি অরণ্যের কথা। পার্বত্য বান্দরবানের জীবনরেখা শঙ্খ নদীর উৎপত্তি  এ অঞ্চল থেকে। ২৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর উৎপত্তি এ এলাকার লাগপাই সংলগ্ন এলাকায়। এ অরণ্যের ঝিরি ঝরনা, সবুজ পাহাড় এমন এক নদীর সৃষ্টি করেছে যা পুরো অঞ্চলের নৌ যোগাযোগ, মানুষের পানীয়জলসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল উৎস। অরণ্য না থাকলে থাকবে না শঙ্খ নদীও। এ নদীর সঙ্গে এর উৎস্থলে থাকা অরণ্যের সম্পর্কের কথা বলছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নদী বিশেসজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত।

‘নির্বাচারে গাছ কাটলে মাটি সরে যায়। ফলে বর্ষার সময় ঢলের সঙ্গে তা ধুয়ে যায়। এর ব্যাপক পরিবেশ গত ঝুঁকি রয়েছে। সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চল যদি না থাকে তাহলে শঙ্খ নদীও হুমকির মুখে পড়বে। এখানকার জীববৈচিত্র্য, শঙ্খ নদীকে রক্ষা করতে হলে সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্টকে বাঁচাতে হবে। ’

ধ্বংসের পূর্বাপর

বন বিভাগের আইনে রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কোনো মনুষ্য বসতি তো দূরের কথা, সেই অঞ্চলে কোনো কাজে ঢুকতে হলেও অনুমতি লাগবে। কিন্তু সাঙ্গু সংরক্ষিত বনের ভেতরে এখন বাস করছে ২৩৯ পরিবারের ১৬শ মানুষ। ব্রিটিশ আমল থেকে এখানে সামরিক বাহিনীসহ বিভিন্ন জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উপস্থিতি থাকলেও সাধারণ মানুষের বসতি স্থাপন শুরু হয় ২০০০ সালের কাছাকাছি সময়ে। স্যাটেলাইট ইমেজসহ সরেজমিন অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া যায়। অপরিকল্পিত জুমে ধ্বংস পার্বত্য সংরক্ষিত অরণ্য২০০৭-৮ সালের দিকে সামরিক বাহিনী অরণ্য থেকে লোকবসতি সরিয়ে দিলেও পরবর্তী সময়ে আবারও বসতি স্থাপন হয়। আর তারই খেসারত দিচ্ছে সাঙ্গু সংরক্ষিত অরণ্য। একদিকে শহুরে অনুপ্রবেশকারী গাছ চোরদের উপদ্রপ, অন্যদিকে অনিয়ন্ত্রিত জুমে ধ্বংস হচ্ছে অমূল্য এ অরণ্য ভূমি। সাঙ্গু অরণ্যের আয়তন ৩৩ হাজার হেক্টর। ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে ৭০ শতাংশ বন।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জুম ভিন্ন তেমন কোনো বাঁচার অবলম্বন না থাকলেও এ অরণ্যের জন্য সাক্ষাৎ যমের ভূমিকা নিচ্ছে জুম। জুমিয়ারা জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে আগাছা পুড়ে পরিষ্কার হয় নির্দিষ্ট এলাকা। বড় গাছ জুমিয়ারা না কাটলেও জুমের আগুনে পুড়ে জীবনীশক্তি শেষ হচ্ছে বিশাল সব মাতৃবৃক্ষের। জুমের আগুনে ভূমি স্তরের দুই থেকে পাঁচ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা পুড়ে যায়। নিয়ম অনুযায়ী কোনো পাহাড়ে জুম হওয়ার ১৫/২০ বছর পরে আবারও জুম হওয়ার কথা থাকলেও জায়গার অভাবে দেখা যাচ্ছে তিন-চার বছর পরেই পুনরায় সেখানে জুম হচ্ছে। ফলে বন আর নিজ জায়গায় ফেরত যাওয়ার সময় পাচ্ছে না। মাঝখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন আর শঙ্খ নদী।

মাটি আলগা হয়ে নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলেছে অনেক জায়গায়। পরবর্তিত হচ্ছে এর উপর নির্ভর করে থাকা ইকো সিস্টেম। এখন শুকনো মৌসুম তো দূরের কথা, অনেক সময় বর্ষা মৌসুমেও এ নদীর অনেক জায়গায় নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। আর বান্দরবান শহর ও উপজেলা শহরগুলোতে গরমের সময় তীব্র হয়ে উঠেছে পানি সঙ্কট। এ অরণ্যকে তাই বাঁচাতেই হবে স্থানীয় আদিবাসীদের স্বার্থে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্য এবং এর জীববৈচিত্র্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন শাহরিয়ার সিজার রহমান।

‘সাঙ্গু সংরক্ষিত অরণ্য বাঁচাতে হলে সেখানে মানুষের উপস্থিতি একটি হুমকি। অরণ্যকে তার নিজের মতো করে থাকতে দিতে হবে। এর ভেতরে বসবাসকারী ২৩৯ এবং এর উপর নির্ভরশীল পরিবারকে সরকারি পৃষ্টপোষকতা করতে হবে। যাতে বনের উপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে। শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক সাবলম্বিতা নিশ্চিত করে তাদের নিজেদের বন রক্ষায় সম্পৃক্ত করতে হবে। তথাকথিত পুনর্বাসন না করে টেকসই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। ’

সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা মাতামুহুরি সংরক্ষিত অরণ্যের। এটি বর্তমানে সরকারিভাবে ঘোষিত একটি ইউনিয়ন। যেখানে এখন দশ হাজার মানুষের বাস। এক সময়ের চারলাখ হেক্টরের কাসালং রিজার্ভ ফরেস্ট এবং রাইক্ষ্যং অরণ্যেও নির্বিচারে হচ্ছে জুম, চলছে গাছ কাটা। স্বল্প জনবল নিয়ে বন বিভাগও অনেকটা অসহায়। প্রকারান্তরে যা স্বীকার করলেন বাংলাদেশ বন বিভাগের পরিবেশ ও বন্যপ্রাণ বিভাগের প্রধান জাহিদুল কবীর।

‘আমরা যা হারাচ্ছি তার আগামী ১০০ বছরেও আর ফিরে আসবে না।   এখনই নদী শুকিয়ে গেছে, ঝিরিগুলোতে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। গাছ কাটা, অপরিকল্পিত জুমের ব্যাপারে আমরা এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। এ ব্যাপারে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে হবে। ’

ব্রিটিশ শাসনের সময় অরণ্যময় পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৪ শতাংশকে সংরক্ষিত ঘোষণা করলেও বর্তমানে কত শতাংশ সংরক্ষিত রয়েছে তা নিয়ে নতুন করে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।