ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের শিশু-০৪

ইটভাটায় পুড়ছে শিশুর ভবিষ্যৎ

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৬
ইটভাটায় পুড়ছে শিশুর ভবিষ্যৎ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

[কখনো জেলে, কখনো কৃষক, কখনোবা কঠোর পরিশ্রমী দিনমজুর। দারিদ্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত জীবন।

শিক্ষা যেখানে আমাবশ্যার চাঁদ। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি যাদের নিয়ে যায় হাড়ভাঙা কর্মে। শিশু সুরক্ষার কথা ওরা জানে না, অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই জীবনের সার কথা। শৈশব থেকেই বিবর্ণ কর্মজীবনের সূচনা। যেখানে জন্ম থেকেই ঘৃণা আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে কন্যা শিশুরা। অপরিণত বয়সেই বিয়ে, অতঃপর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মা ও শিশু। দুর্যোগ ঝুঁকি যাদের নিত্যসঙ্গী। উপকূলীয় প্রান্তিক শিশুদের অন্তহীন দুর্দশার এই চিত্র তুলে এনেছে বাংলানিউজ। বরগুনা করেসপন্ডেন্ট সুমন সিকদারের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ পড়ুন চতুর্থ পর্ব। ]

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: উপকূলের ইটভাটাগুলোতে বছরের বড় একটা সময় জুড়ে চলে শিশু শ্রমের মহাযজ্ঞ। এ যজ্ঞের আগুনে প্রতিনিয়ত পুড়ছে হাজার হাজার শিশুর ভবিষ্যৎ। ইটভাটার মালিকরা কম মজুরিতে বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার লোভে শিশুদেরই ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে জড়াচ্ছেন।

দারিদ্রের বেড়াজালে বন্দি হয়ে ইটভাটাগুলোতে চাপা পড়ছে এসব শিশুর ‘রঙিন’ ভবিষ্যৎ। যে বয়সে তাদের থাকার কথা বাবা মায়ের আদরে, সেখানে তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ব্যস্ত সময় পার করছে। এতে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে এসব শিশুরা।

বরগুনা সদর, পাথরঘাটা ও আমতলী উপজেলার বেশ কয়েকটি ইটভাটায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুপুর বেলা রোদের মধ্যে কাজ করছে একদল শিশু। এদের সবারই বয়স ৮ থেকে ১৬ বছর। জীবন-জীবিকার তাগিদে কেউ এসেছে তার মা-বাবার সঙ্গে, কেউ শ্রমিক সরদারের সঙ্গে।

এসব শিশুরা সাতক্ষীরা ও খুলনার বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসেছে ছয় মাসের কাজের চুক্তিতে। চুক্তি ফুরালেই আবার ফিরবেন আপন ঘরে। তবে ততো দিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হবে পুরোমাত্রায়।

বরগুনার সব ইটভাটাতেই ভাটার বড় শ্রমিকদের পাশাপাশি কাঁচা ইট রোদে শুকানো, ইট তৈরি, ট্রলিতে করে ইট টেনে ভাটাস্থলে পৌঁছানো, মাটি বহন করাসহ সব কাজেই নিয়োজিত আছে এই শিশুরা। প্রত্যেক কাজই বড়দের মতো করে করতে হয় তাদের।

ছোট বেলা থেকেই ইটভাটায় কাজ করতে করতে যেমন শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়ছে এখানকার শিশুরা, ঠিক তেমনি কাজ করতে করতে মারাত্মক সব রোগের শিকার হতে হচ্ছে ইটভাটায় কর্মরত শিশুরা। শিশুকাল তাদের মনের পাশাপাশি শরীরেরও গঠন প্রক্রিয়া শুরু হতে থাকে। কিন্তু ভাটার শিশুদের মন ও শরীর দুটো আক্রান্ত হয় রোগে-শোকে।

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আলমগীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, উপকূলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইটভাটায় কর্মরত শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। ইটভাটায় দীর্ঘ সময় কাজ করার ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, এজমা, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

বরগুনা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলায় অনুমোদিত ইটভাটা ২৭টি। অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ভাটার সংখ্যা ৫৪টি। এর মধ্যে পরিবেশ ছাড়পত্র আছে ৩২টির, অনুমোদনহীন ইটভাটা ১৫টি ও ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনি আছে ৭টি। তবে স্থানীয় হিসাবে জেলায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ১০০টি ইটভাটা ও পাঁজা আছে। প্রতিটি ইটভাটাতেই শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে।

শ্রম আইন-২০০৬ এর ২৮৪ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করলে, অথবা আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করে কোনো শিশুকে চাকরি করার অনুমতি দিলে, তিনি ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে শিশুদের নিযুক্ত করার বিষয়ে বরগুনা ইটভাটা সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, অধিকাংশ ইটভাটাতেই শিশু শ্রমিক নেই, তবে কিছু শিশু আছে যারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে এখানে আসে। এক্ষেত্রে তাদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় না।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় ৫৪টি ধারার মধ্যে সরাসরি শিশুর সুরক্ষা বিষয়ক ২৪টি ধারা রয়েছে। ধারা ৩২-এর ১-এ বলা আছে, শরীক রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশুর অধিকারকে রক্ষা করবে এবং শিশুর শিক্ষায় ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী কিংবা তার স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর কাজ করানো না হয়, সে ব্যবস্থা নেবে।

এই শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী ১৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু এখনো দেশে এই সনদের বাস্তবায়ন হয়নি। শিশুরা এখনো অরক্ষিত, এখনো গড়ে ওঠেনি আলাদা মন্ত্রণালয়।

জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যে সব ইটভাটায় শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৬
এসএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।