ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

ফেনী নদীর ভাঙন

কৃষিজমি-বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব শত শত পরিবার

সোলায়মান হাজারী ডালিম,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৫
কৃষিজমি-বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব শত শত পরিবার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফেনী: শতবর্ষী করিমুন্নেসা। ভরদুপুরে মাঝ নদীর দিকে তাকিয়ে।

কারণ জানতে চাইলে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেন- ‘এইতো, বছর খানেক আগেও ওইখানে ছিল আমার ভিটে-মাটি, ছিল সাজানো সংসার। আজ সব শেষ’।

করিমুন্নেসা এখন অন্যের বাড়ির আশ্রিত। নদী কেড়ে নিয়েছে তার সব। তার ভিটে-মাটি এখন মাঝ নদী।

তিনি ফেনী নদীর ছাগলনাইয়ার লাঙ্গলমোড়া অংশের ভাঙন কবলিত এলাকার বাসিন্দা। শুধু করিমুন্নেসাই নন, গত দুই বছরে এ ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে শতাধিক ঘর-বাড়ি, বসতি জমি, টিউবওয়েল, পুকুর, স্থানীয়দের সহায় সম্বলসহ নদী রক্ষা বাঁধ। আর গত ৫ বছরে আরো শতাধিক পরিবার ভিটে-মাটিহীন হয়ে অন্যত্র চলে গেছে। ওই এলাকার কৃষকরা হারিয়েছেন কয়েকশ’ একর ফসলি জমি।

বর্তমানে তিনটি গ্রামের বিশাল এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি বাড়ি এখন বিলীন হওয়ার পথে।

এরই মধ্যে বিলীন হওয়া বাড়ির মধ্যে রয়েছে নুর মিয়া হাজীর বাড়ি, পণ্ডিত বাড়ি, হাজী বাড়ি, মহিউদ্দিন ড্রাইভারের বাড়ি, কামাল ডাক্তারের বাড়ি, জব্বর আলী মাঝির বাড়ি, শাহ আলমের বাড়ি, দিল আহমদের বাড়ি, পণ্ডিত বাড়ি (দক্ষিণ), ওহিদ মিস্ত্রির বাড়ি, আলী উদ্দিন মুন্সীর বাড়ি, মনসুর আলীর বাড়ি, হাজী আব্দুল মুন্সীর বাড়ি, জালাল আহমদের বাড়ি, ভোলা মিয়ার বাড়ি, তাহের আহমদের বাড়ি, মালেক সওদাগরের বাড়ি, রহমত আলী মাঝির বাড়ি, আকরাম আলী হাজীর বাড়ি, মোস্তফা মিয়ার বাড়ি, জসিম ডাক্তারের বাড়ি।

এলাকার বাসিন্দা মিলন জানান, ২০০৪ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এলাকাবাসীকে নদী ভাঙন থেকে রক্ষা করতে সাড়ে আট কিলোমিটার দীর্ঘ ‘মিজান বাঁধ’ নির্মাণ করে। কিন্তু নদীর ক্রমাগত ভাঙনের ফলে এখন মিজান বাঁধেরও প্রায় এক মিলোমিটার এলাকা নদীর পেটে চলে গেছে।

মোহাম্মদ ইউনুস ও আবুল কাশেম জানান, বর্তমানে মহিউদ্দিন, শহীদুল্লা ও নাসির আহমদের ঘরের প্রায় ৭০ শতাংশ নদীতে চলে গেছে। বাকিটাও কিছুদিনের মধ্যে বিলীন হবে। এলাকার অর্ধশতাধিক পরিবার বর্তমানে মিজান বাঁধের ওপর বসবাস করছে। অনেকেই বসতি হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা মোস্তফা মিয়া বাংলানিউজকে জানান, একদিন এখানে অনেকেই ছিলেন স্বচ্ছল গৃহস্থ। কিন্তু জমি ও বসতি হারিয়ে এখন অনেকেই নিঃস্ব।

জসিম উদ্দিন নামে আরেক যুবক জানান, ৫ বছর আগে নদীর অবস্থান আরো প্রায় আধা কিলোমিটার পূর্বদিকে ছিল। এখন ভাঙনের ফলে নদী বেঁকে গিয়ে আধা কিলোমিটার পশ্চিমে চলে গেছে। এর ফলে ছাগলনাইয়া অংশ কমছে ও চট্টগ্রামের মিরসরাই অংশ বাড়ছে। তারা জানান, উপজেলার মানচিত্রই পাল্টে যাচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলেই এ ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে।

সরেজমিনে ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীর উত্তর লাঙ্গলমোড়া, দক্ষিণ লাঙ্গলমোড়া ও মুহুরীগঞ্জ অংশে ১০ থেকে ১২টি ট্রলারে ছোট আকারের ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে।

কারা অবৈধভাবে বালু তুলছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সবাই চুপ। কেউ কেউ বলেন, তারা প্রভাবশালী মহল। অন্য এলাকা থেকে এসে বালু নিয়ে চলে যান। লাঙ্গলমোড়া নদীভাঙন এলাকা থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিণে ধুমঘাট ব্রিজ এলাকায় গিয়েও কথিত ইজারাদারদের পাওয়া যায়নি।

ড্রেজার ও ট্রলারকর্মীরা জানান, মহালের ‘মালিকরা’ এখানে থাকেন না। ট্রলারগুলো ভাড়ায় চালিত। তারা ট্রলার মালিকের নির্দেশে কাজ করছেন। ট্রলার মালিকরা বেশিরভাগ চট্টগ্রামের অধিবাসী বলেও তারা জানান।

ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবুল হাশেম বাংলানিউজকে জানান, ফেনী জেলার ২০টি বালু মহালের মধ্যে মাত্র ৮টি ইজারা দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে ইজারা দেওয়া হবে। তিনি জানান, ছাগলনাইয়ার লাঙ্গলমোড়া অংশে ফেনী নদীর ঘাটের কোনো ইজারা নেই। কোনো পক্ষ ওই এলাকায় বালু উত্তোলন করলে তা বৈধ হবে না।

তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। সম্প্রতি ফেনী সদরের ফাজিলপুর অংশে অভিযান চলিয়ে বালু উত্তোলনের ড্রেজার ও সরঞ্জাম জব্দ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

তিনি আরও জানান, জেলার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ মহালে অভিযান অব্যাহত থাকবে।

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রমজান আলী প্রামাণিক বাংলানিউজকে জানান, এ ব্যাপারে সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া নেওয়া হবে।

নদীপাড়ের লাঙ্গলমোড়া এলাকাসহ আশপাশের তিনটি গ্রামের মানুষ ভাঙনের হাত থেকে তাদের রক্ষার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান। তাদের আশঙ্কা, শিগগিরই যদি ব্যবস্থা গ্রহণ না করা যায়, তাহলে তাদের আর রক্ষা করা যাবে না।

** মানচিত্রে ছোট হয়ে আসছে ভোলা

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৫
এসএইচ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।