ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

চুনের জন্য শামুক বধে বিপন্ন প্রকৃতি

এস এস সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৩
চুনের জন্য শামুক বধে বিপন্ন প্রকৃতি

বাগেরহাট: চারদিক ধোঁয়াচ্ছন্ন! বাতাসে তীব্র কটু গন্ধ, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। জ্বলছে চোখ।

পাশের বাড়ি থেকে খক খক কাশি শোনা যায় সারারাত।

এ অবস্থা শামুকের খোলস পুড়িয়ে চুন প্রস্তুত করার কারণে। গাছ নিধনে পরিবেশের ক্ষতি, শামুক নিধনে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, শামুকের খোলস পুড়িয়ে চুন তৈরি করায় তীব্রভাবে হচ্ছে বায়ুদুষণ। অন্যদিকে এর বিরূপ প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।

বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার দুর্গাপুর এলাকায় পরিবেশবান্ধব শামুকের খোলস পুড়িয়ে রাতভর তৈরি করা হয় চুন। আর এ চুন তৈরি করতে প্রতিদিন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে শত শত মণ কাঠ। নির্বিচারে নিধন চলছে গাছ। মারাত্মকভাবে বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য-পরিবেশ। এ ঘটনা বছরের পর বছর ঘটে চললেও দেখার কেউ নেই।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি শামুক পানির ময়লা-আবর্জনা খেয়ে ঠিক রাখে জলজ পরিবেশের ভারসাম্য। কিন্তু চুন তৈরি করতে গিয়ে ধ্বংস হচ্ছে গাছ ও শামুক।
Poribes-biponno
বাগেরহাটের জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় প্রায় ৮২ হাজার চিংড়ি ঘের রয়েছে। যার মধ্যে ৩৬ হাজার বাগদা ও ৪৬ হাজার গলদা চিংড়ির ঘের। এসব ঘেরে চিংড়ি মাছের প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় শামুকের মাংস।

শুধু তাই নয়, শামুকের মাংস খাওয়ানো হচ্ছে চিংড়িসহ ঘের ও পুকুরের নানা প্রজাতির মাছকে। তাই বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় নির্বিচারে চলছে পরিবেশবান্ধব শামুক নিধন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এই নিরীহ জলজপ্রাণীটি এখন এ অঞ্চলে বিলুপ্তির পথে।

চিতলমারীর চিংড়ি চাষী রেজাউল খান ও বুদ্ধ বসু বাংলানিউজকে জানান, মাছের খাদ্য হিসেবে এখন শামুক একটি লাভজনক ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই অতি মুনাফালোভী শামুক ব্যবসায়ীরা মাদারীপুরের কালকিনি, বরিশালের গৌরনদী ও গোপালগঞ্জের বিভিন্ন বিল থেকে শামুক নিয়ে আসেন চিতলমারী, ফকিরহাট ও মোল্লাহাটের বিভিন্ন আড়তে।

তারা জানান, সেখান থেকে চাষীরা শামুক কিনে, তাজা শামুক হত্যা করে মাছের খাবার হিসেবে পুকুর ও চিংড়ি ঘেরে দেন খাদ্য হিসেবে। এতে এ অঞ্চলে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ শামুক নিধন করা হচ্ছে। আর এজন্য প্রতিদিন কমপক্ষে অর্ধশতাধিক ট্রাক ও ট্রলার ভরে শামুক আসে এখানে।
Poribes-biponno
রেজাউল ও বুদ্ধ বসু আরও জানান, হাজার হাজার মণ শামুকের খোলস দিয়ে তৈরি হয় চুন। এজন্য চিতলমারী উপজেলা সদর থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সবিতা চুন ঘর। শামুকের খোলস পোড়ানোর জন্য রয়েছে বড় একটি চুল্লি। যে চুল্লির ধোঁয়া আর কাঁচা শামুকের খোলস পোড়ানোর গন্ধে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। আর শামুক পুড়িয়ে চুন বানাতে প্রতিদিন পুড়ছে শত শত মণ কাঠ। জ্বালানির জন্য নির্বিচারে ব্যবসায়ীরা কাটছে অপরিপক্ক গাছ। এতে মারাত্মকভাবে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ।

চুল্লির পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক মো. সাফায়েত হোসেন বাংলানিউজকে জানান, রাতে যখন বড় ইলেট্রিক ফ্যান দিয়ে চুল্লিতে আগুন দেওয়া হয়, তখন চারদিক ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যায়। বাতাসের তীব্র গন্ধে আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চোখ জ্বালা-পোড়া করে। শিশু ও বয়স্করা কাশিতে ভোগেন। চুল্লির চারপাশের প্রায় দু’কিলোমিটার এলাকার মানুষের রাতে ঘুমানোই কঠিন হয়ে ওঠে।

চিতলমারী ক্লিনিকের নির্বাহী পরিচালক ডা. শেখ ফারুক আহম্মেদ বাংলানিউজকে জানান, কাঁচা শামুকের খোলস পোড়ানোয় বাতাসে এক প্রকার বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হয়, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

এ ব্যাপারে সবিতা চুন ঘরের মালিক শম্ভু সূত্রধর বাংলানিউজকে জানান, শামুকের খোলস ও কাঠ তিনি টাকার বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে কেনেন। রাতের আঁধারে আগুন জ্বালানোয় মানুষের তেমন একটা ক্ষতি হয় না।

আর মাঝে মধ্যে একটু ঝুট-ঝামেলা হলে ওগুলো টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয় বলেও তিনি জানান।
Poribes-biponno
চিতলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুলু বিলকিস বানু বাংলানিউজকে জানান, তিনি চিতলমারী অল্পদিন হলো এসেছেন। বিষয়টি তার জানা নেই। তবে ঘটনা সত্য হলে অবিলম্বে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের ইন্সপেক্টর মো. রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, চুন পোড়াতে হলে অবশ্যই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র থাকতে হবে। এছাড়া জ্বালানি হিসেবে বৃক্ষ নিধন করা আইনসঙ্গত নয়।

তবে বাগেরহাট জেলা পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ডিডি) সুকুমার সাহা বাংলানিউজকে বলেন, শম্ভু সূত্রধর ছাড়পত্র নিয়েছেন কিনা, এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। এ ধরনের পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ করলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।    

বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৩
এএ/এমজেএফ/ এএসআর/বিএসকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।