ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রকৃতি ও দেহচেতনার অরণ্যবাক্য ‘ম্যানগ্রোভ মন’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪০ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৮
প্রকৃতি ও দেহচেতনার অরণ্যবাক্য ‘ম্যানগ্রোভ মন’ প্রচ্ছদ

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সুদীর্ঘ ইতিহাসের কালস্রোতে নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্থান-পতন এবং ভাঙা-গড়ার স্মৃতিকে ধারণ করেই আধুনিকতা পার অধুনান্তিকে বাংলা কবিতা বহমান। কিন্তু বহমান ধারার বহুমুখের মধ্যে থেকে অপার এই বাংলার চরাচর ছুঁয়ে প্রকৃতির কাছে নিজের আখরের পুরুষ-সত্তা যে ক’জন প্রকাশ করতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চলের বরগুনার ভূমিপুত্র, কবি রাজু আহমেদ মামুন অন্যতম।

প্রকৃতির আয়নায় নিজের পুরুষসত্তা জন্মচক্রের ইতিবৃত্তে, কামনা ও দ্রোহে মিশে থাকা প্রাকৃতিক বিস্তারে, জীববৈচিত্র্যে, প্রকৃতির দেহচেতনায়, ইন্দ্রিয় ও অতিন্দ্রিয়ে কবি রাজু আহমেদ মামুন তাঁর সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘ম্যানগ্রোভ মন’কে নিয়ে এসেছেন বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায়।

যখন বাংলার সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে প্রকৃতি-বিধ্বংসী বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঠিক তখনই অরণ্য আবহে বেড়ে ওঠা কবি রাজু আহমেদ মামুন তাঁর ‘ম্যানগ্রোভ মন’-এ পেশ করেছেন প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর অর্থাৎ বাংলার ব্যক্তিসত্তার অখণ্ডতা, পরিবেশ চেতনার দেহজ বয়ান, কবিতায়, কাব্যে।

‘ম্যানগ্রোভ মন’ মোট ৪০টি কবিতার সিরিজ। সবকটি কবিতা মিলিয়ে গড়ে উঠেছে কাব্য। সুন্দরবনের রুপ-রহস্য-লীলা বন্দনার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থ। বনবিবির দেহের কলা, দেহের নন্দনের কাছে নিজের অস্তিত্বের আকুতি ব্যক্ত করেছেন কবি।

‘অমন আদুরে আদুরে ঠোঁটে/ কে চুমু খায় দেবী!/ ওই সুডৌল স্তন স্থির চুম্বকের মতো টানে-/ অস্থির টানে। / অমাবস্যা হয়ে ফুটে ওঠে নাভিগর্ভ তোমার.../

সুন্দরবনের জীব জগতের বৈচিত্রের মধ্যে নানা রঙ ও প্রকরণের যে বৈচিত্র্য তা ইম্প্রেশনিস্ট পেইন্টং-এর মতো ধরা রয়েছে এই কাব্যগ্রন্থের কবিতামালায়।  

যেখানে অরণ্যের প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্গে মানবচেতনার আন্তঃসম্পর্ক খণ্ডখণ্ড ইমেজে ইমেজে প্রকাশ পেয়েছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা-কামনা-বাস্তুচক্র-রাত-নক্ষত্র উজ্জ্বল আকাশ আর মায়া মায়া অন্ধকার একইসাথে মিলে মিশে আছে।

‘মৌচাক ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাদ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী/ ভনভন আওয়াজ, বলগা বাতাসে কেওড়া পাতার শিস/ বানরের চিৎকার/ হঠাৎ নড়ে ওঠা গোলবন ছেড়ে ছুটন্ত ক্ষুধা/ দৌড়-দৌড়-দৌড় জীবনের সমান দৌড়/’ এভাবে চলতে থাকে, দেখা যায়, ‘গীলা লতার আড়ালে নড়ছে ঝরাপাতা, প্রাচীন সরীসৃপ/ খুলে নিচ্ছে শরীরের প্যাঁচ, প্যাঁচানো খালের শরীরে/পোয়াতি শূকরীত্র মতো ফুলছে জল, জলের তলায়/ হাঙর কুমির খেলা করে ভেটকি কোরাল/’

এবং এসবের মাঝখানেই অরণ্যে জলরেখার জলযানে বসে থাকেন এক মাতাল শিকারী। যিনি এই প্রাণবৈচিত্র্যের মনোমুগ্ধকর খেলা থামিয়ে দিতে হানা দেন এই জঙলাভূমে, রাত্রিকে করে দেন বন্ধ্যা, থমকে যায় কাল, কালপ্রবাহ। যেভাবে ফিন্যান্স ক্যাপিটাল-উপযোগী ডেভলপমেন্ট মাতাল শিকারির বেশে হানা দেয় আমাদের জল-জমিন-জঙ্গলে, আর পারমানবিক চুল্লির ছাই ওড়ে আমাদের স্বপ্নের ভিতরে। কারা যেন উজাড় করে দিতে চায় আমাদের সুন্দরী গাছগুলিকে, আমাদের হরিণ-হরিণী আর হলুদ-কালো ডোরাকাটা বড় মিঞার হালুমকে, থামাতে চায় মৌমাছি গুনগুনকে।

এই কাব্যগ্রন্থে সুন্দরবনের যাপনের নানা মুহূর্ত, নানা অভিব্যক্তি, নানা বিভঙ্গ অক্ষর-বাক্যের ইমেজে প্রকাশ পেয়েছে। নুনপোড়া রোদের তাতানো সৈকতে নানা কারবারের জিগির, বাঘের দেবতা গাজীর পাশাপাশি রাধাকৃষ্ণ মন্দির আর কৃষ্ণ অন্ধকারে ঢাকা আলো হয়ে ফুটে ওঠা রাস উৎসব। পৌরাণিক মোয়ালের মনে তারপর জেগে ওঠে চাঁদ, আর ‘চম্পাবতী রূপবতী রোদেলা শরীর/ ইলিশ আঁশের মতো রূপালি নখর/ গাজীরে পাগল করে সোহাগ খেলায়...’ প্রকৃতিতে ফুটে থাকা এই বুনোসৌন্দর্যের সঙ্গে মিলিয়ে কবি ফিসফিস করে বলে ওঠেন, ‘হাঃ এমন যদি হতো হাসমতের মা’!

আসলে কোনো আতুপুতু সুখী নগর জীবন জানে অনিশ্চয়তা আর রহস্যে ঘেরা অরণ্যজীবনের চারপাশ ঘিরে থাকে মৃত্যুর ভয়। তারই মাঝে জাগে প্রণয়, কাম আর তার ভিতর থেকে ফুটে ওঠা অস্তিত্বের কাব্যভাষা। যা এই কবিতার বইটিতে ফুটে উঠেছে। ফুটে উঠেছে গান, শৃঙ্গার, স্বপ্নের শ্বাসমূল...

মৃত্যুর মতো তীক্ষ্ণ গতিতে এই কবিতার ঢুকে পড়েছে জীবনের বাঘ, সেই বাঘ কিন্তু আসলেই প্রবল প্রাণের উচ্ছাস, সেই প্রাণের সাথে একদা লড়াই করেছিলেন পশ্চাব্দি গাজীরা, আজ তাঁরা ফিরে যান, ‘শপথ নিয়েছে গাজী, ফিরে যাবে বাড়ি/ বনের বাঘেরা তবে বনেই বেঁচে থাক। ’ এই কবিতার সিরিজটি পাঠ করার প্রয়োজন আমাদের সমষ্টিগত নির্জ্ঞানে লুকিয়ে থাকা জঙ্গলচেতনা আর প্রকৃতিমুখরতার সঙ্গে অস্তিত্বকে মেলাতে। এই সিরিজে বাংলা কবিতার পদাবলী ধারা ও গীতি কবিতাকে অধুনান্তিকে পরিবর্ধন করা হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থ ভীষণভাবেই শরীরী, যে শরীর প্রকৃতির আধারবিন্দুতে চালনা করার, যে শরীর প্রেমের, কামনার, যে শরীর সংগ্রাম আর প্রতিরোধের।

এই কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে যে কথাগুলি খুব জোরের সঙ্গে বলা দরকার, তা হল, কবিতায় ব্যবহৃত ইমেজ ও তার অর্গ্যানিক ভ্যালু। অরণ্যচেতনাকে দেহচেতনার সঙ্গে মিলিয়েছেন লৌকিক ঢঙে। অরণ্য যেমন শরীরী তেমনই আমাদের লোক-ইতিহাস ও ঐতিহ্যও দেহ-নৌকার বহমান ধারা। কেননা, আমাদের দার্শনিক প্রত্যয়, যাহা আছে ভাণ্ডে তাহাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। দেহভাণ্ডে তাই ‘ম্যানগ্রোভ মন’ অনায়াসে ঢেলে নেয় প্রকৃতিজগতকে। এবং তা কোনো তল-বিভাজনে উপর থেকে পর্যবেক্ষণ নয়। বরং জঙ্গলের ভিতরের দীর্ঘযাপন থেকে এ লেখা। এ লেখা শরীর দিয়ে। শরীরের স্পন্দন দিয়ে, শরীরের প্রতিবর্ত দিয়ে এবং শরীরের ভিতরে যে মনের ধারনা সেই মনে নির্জ্ঞানের আদির বহতা দিয়ে... অর্থাৎ এই কাব্যগ্রন্থের চল্লিশটি কবিতা মিলিয়ে একটাই কবিতা, একটাই কাব্য এবং তা এই অধুনান্তিক সময়ে প্রকৃতি পদাবলী। এই কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি যিনি কিনা পুরুষ তিনি তাঁর আদিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতির কাছে নিজের শব্দ-সত্ত্বাকে করেছেন সমর্পণ। আসুন, আমরা প্রকৃতির কাছে পুরুষের, অরণ্যের কাছে ভূমিমানুষের সেই সমর্পণের শব্দ পাঠ করি।

ম্যানগ্রোভ মন- রাজু আহমেদ মামুন
প্রকাশনা- কাগজ
প্রচ্ছদ – মোস্তাফিজ কারিগর
মূল্য- ২২৫ টাকা

বাংলাদেশ সময়: ০৬৩৭ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৮
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad