ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

গল্প

বিহারি কলিম | হানিফ মোল্লা

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৮
বিহারি কলিম | হানিফ মোল্লা বিহারি কলিম | হানিফ মোল্লা

চল্লিশ পার হওয়া কলিম রাস্তার মোড়ে লেখার অযোগ্য খিস্তি করে যাচ্ছে বিকট শব্দে! রাত অনেক হয়েছে। এলাকার ভদ্রলোকেরা অনেকেই বিশেষ করে মুখে কথা ফুটছে এমন বাচ্চার মায়েরা কলিমের খিস্তি শুরু হলেই ধপাধপ দরজা জানালা লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পাছে বাচ্চারা এইসব খিস্তি মুখস্ত করে ফেলে এই ভয় তাদের মনে।

একটা ব্যাপার তাদের মাথায় এখনও পরিষ্কার না। কলিম এতো এতো বিশ্রী ভাষায় কাকে গালি দেয়? মাঝে-মধ্যে দেশের হর্তা-কর্তা থেকে শুরু করে আল্লাহ-খোদা কাউকে ছাড় দেয় না।

দুনিয়ার তামাম জিনিসের প্রতি তার রাগ। এই রাগ বা বিরাগের গভীরে যায় না কেউ। কীই-বা দরকার। তাকে পাড়া-পড়শি সবাই চেনে। কারও পানির কল নষ্ট হয়ে গেলে বা গ্যাসের চুলা সারাতে এই এলাকার একমাত্র ভরসা কলিম।

অদূরে নেড়ি কুত্তারা রাস্তার অপর প্রান্তে কলিমের এইসব খিস্তি শুনে অভ্যস্ত। তারা এতে বাগড়া দেয় না। আর বাগড়া দেবেই বা কেন? কলিম তো আদতে তাদের মতোই। কেবল চেহারাটা মানুষের মতন। কোনো কোনো দিন রাতে মাতাল হয়ে অনেক গালাগালির পর প্রায় ভোরের দিকে, এই কুকুরদের যেকোনো একটার গলা জড়িয়ে বা পাশে শুয়ে অঘোরে মদের নেশায় মাঝে-মধ্যে ঘুম দিয়ে দেয় কলিম ওরফে কলিমুল্লাহ মিস্ত্রী।

পাকা হাত আছে লোকটার। কোনো কাজের ফরমায়েশ পেলেই অগ্রিম কিছু টাকা তাকে দিতেই হবে। নইলে সে নিজ থেকে চেয়ে নেয়। চট করে ঘরের ডাল-চাল আলু কিনে দিয়ে আসে আর সাথে বাংলা মদের বোতল তো আছেই। সে বোতল বেশিরভাগ সময় গভীর রাতে খোলে। জটিল কোনো কাজ তার হাতে পড়লে আগে গলা হালকা করে ভিজিয়ে নেয় গোপনে। একবার তো এই অবস্থা হয়েছে- ওয়াসার অবৈধ লাইন দিতে গিয়ে রাস্তায় বিশাল খাদ করে মদ খেয়ে এক হাতে রেঞ্জ নিয়ে কাঁদা পানিতে বেহুশ হয়ে পড়ে ছিলো। তার মুখের উপর মাছি ভন ভন করে ঘুরপাক অবস্থা। কলিম জাতে বিহারি মুসলমান। তার জন্ম এই চাটগাঁ শহরেই। তার বাপ তার দাদার হাত ধরে এই দেশে এসেছিল সেই বহুবছর আগে। বাপ-দাদা মরে এখন অচেনা দেশের নাগরিক। মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। অন্তত কলিমের মতো বেঁচে থেকে এতো পেরেশান জীবনের ঘানি টানতে হচ্ছে না।

কিন্তু তার মা বেঁচে আছে এখনও। বুড়ি এখনও পাকা বিহারি ভাষায় কথা বলে। কলিমের দুই ছেলে এক মেয়ে। তার বউ কলিমের মতোই চাটগাঁ শহরের আরেক প্রান্তের মেয়ে। হাজি ক্যাম্প জায়গাটার নাম। জেনারেল জিয়া যেই বছর প্রেসিডেন্ট হলো তার দুই এক বছরের ধারে কাছে কোনো একটা সময় সে বিয়ে করেছে। সেই বছর, তার বিয়ের পরে পরেই কী জানি কী চুক্তির কারণে বিহারি কিছু লোক পাকিস্তান চলে গেলো। কলিম নতুন বউ পেয়ে তখন আর ওইসবে মন দেয়নি খুব একটা। যদিও তার মা তাকে এই ব্যাপারে খুব করে তাড়া দিয়েছিল বার বার। সে তার মাকে প্রশ্ন করে-

কাহা সে আয়া তুম?

তার মা সরল গলায় বলে, বিহারসে!

কলিম এর পরেই যা বলে তা হলো, বিহার থেকেই যদি আসো তো পাকিস্তান কেন যাবে? আর পাকিস্তান কেনই বা তাদের নিচ্ছে? তার মা অতসব বোঝে না। বুড়ি কেবল জানে বিহার থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলো। সেটা এখন বাংলাদেশ। আর পাকিস্তানে নিয়ে কোথায় থাকতে দেবে, কী করবে এই সব ভাবনাকেও ঝামেলার মনে হয় কলিমুল্লাহর কাছে।

বুড়ি বিহার থেকে কেবল ভাষাটাই সাথে করে আনেনি। নাতি-নাতনিকে সেই বিহার দেশের গল্প শোনাতে চায়। কলিমের বাচ্চারা সেই গল্পে খুব একটা আগ্রহ পায় না। কলিমুল্লাহ বিহারি ভাষাটা তার পারিবারিক ব্যবহারের জায়গায় রাখে অথবা তার মতো আর যারা এইখানে ট্রেড স্কুলে বাস করে তাদের সাথে চালায়। বাংলা কথা বলায় সে পুরোদস্তুর বাঙালির মতো হলেও একটা বিহারি টানে সেই কথাকে সুরেলা লাগে।

ট্রেড স্কুল নামটাই এখন থেকে গেছে। সেই কবে পাকিস্তান আমলে এইখানে ক্লাস বসতো। একাত্তরের যুদ্ধের পর সব এখন ইতিহাস। কলিমের বাপ-দাদারা দেখেছে এক ভাঙন আর কলিম দেখেছে আরেক ভাঙন। ভাঙতে ভাঙতে কলিমের মতো বিহারিরা খুব ছোট একটা জায়গায় এসে ঠেকেছে। এখন দেড়শোর মতো বিহারি পরিবার থাকে। শহুরে বস্তিবাসীরা এই থাকার জায়গা দেখে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারে। এতটাই ভয়াবহ থাকার অবস্থা! মল-মূত্রের গন্ধে ভরে থাকে জায়গাটা। এদের জাতের মধ্যে যারা একটু লেখাপড়া করতে পেরেছে বা ছোট-খাটো ব্যবসা করতে পেরেছে তারা এখন ভদ্র লোকদের সাথে বাস করে। এইখানে কলিমের পড়শিরা সব তার মতোই দিনে আনে দিনে খায় ধরনের লোকজন। বাচ্চাদের লেখাপড়া করার ব্যবস্থা বলতে একটা এনজিও পরিচালিত স্কুল। সেখানে বড়জোর পাঁচ ক্লাস। এরপর বাচ্চারা টেম্পুর হেলপার বা নানান বিচিত্র পেশায় চলে যায়।

খেতে পায় না ঠিক মতো, পাছায় কাপড় থাকে না যেখানে— সেখানেও মানুষের বিনোদন থাকে বইকি। বিহারি বস্তির এই জায়গাটাতে বছরে দু-একবার কাওয়ালি গানের জলসা বসে। জলসার রাতে কলিম ও তার বস্তির অনেকে মেতে উঠে। গাঁজার ধোঁয়া ওঠে তাদের বস্তির পায়খানা পেশাবের গন্ধ ছাপিয়ে। বড় সাউন্ড বক্সে বেজে উঠে, ‘ইশকে নাবী দিলসে পায়দা করো...’। নবীর ইশক থাকে কী থাকে না জানি না তবে উঠতি বয়েসি ছেলে ছোকরারা এখানে দুনিয়াবী মাস্তিতে মশগুল হয়। সেই মাস্তি থেকে এখানে ছোট-খাটো কথায় মারামারি থেকে খুন খারাবি পর্যন্ত ঘটে যায়।

ঘটনাটা সেই রাতেই ঘটে যেতে পারতো। কিন্তু সেই রাতে কলিমুল্লার ছেলে আরমানের সাথে তাদেরই পড়শি করিমের ছেলে গুড্ডুর সাথে হাতাহাতি হয়ে যায়। বিষয় খুব বেশিকিছু নয়। খুব সাধারণ ব্যাপার। আরমান আর গুড্ডু সমবয়সী বলেই একসাথে আড্ডা দেয় এলাকায় ঢোকার মুখে ব্রিজের গোড়ায়। ব্রিজের বামপাশ ঘেঁষে পান-সিগারেটের একটা দোকান আছে। চাইলে চা বিস্কুটেরও ব্যবস্থা আছে। সেখানে গোটা দুয়েক টুল পাতা। সেই টুলে বসে আরমান আর গুড্ডু রোজ কয়েক ঘণ্টা করে আড্ডা দেয় আর মাঝে-মধ্যে চা আর শেখ সিগারেট খায় ভাগাভাগিতে। গুড্ডু আর আরমান মূলত টেম্পুর ড্রাইভার। আগে হেলপার ছিলো। এই গেলো মাস তিনেক আগেই তারা দুজন হালিশহর টু নিউমার্কেট রুটে টেম্পু চালানো শুরু করে। তাও দিনের যেকোনো এক বেলা। বাকি সময় এই ব্রিজের গোড়ায় বসে চা-সিগারেট খাবার উছিলায় এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া স্কুল-কলেজের মেয়েদের সাথে টাঙ্কি মারে! এটাকে টাঙ্কি মারা ঠিক বলা যায় না। এক প্রকার উত্যক্ত করা বলা চলে। দুজনের পোশাক দেখলে বোঝার উপায় নেই যে তারা টেম্পু ড্রাইভার। ফুটপাতের সস্তা জিন্স আর বাহারি টি-শার্ট পরলে মনে হয় কলেজ পড়ুয়া ছেলে। আর চুলের ফ্যাশন হাল আমলের হিন্দি ফিল্মের নায়ক কিংবা কলকাতার বাংলা ছবির নায়কের মতো করে ছাট দেয়া। কেবল তাদের আসল রূপ ধরতে পারার একটাই উপায়, তাদের সাথে কথা বলা।

দুজনের পারিবারিক অবস্থা গুরুতর খারাপ হলেও তাদের পোশাক আর পকেটের দামী স্মার্টফোন দেখলে বোঝার উপায় নেই যে তারা মূলত টেম্পুর ড্রাইভার। জাল লাইসেন্স আর অপরিপক্ক বয়সে টেম্পু চালিয়ে যে চার-পাঁচশো টাকা আয় করে তার প্রায় পুরোটাই স্মার্টফোনের ইন্টারনেট আর ফোন কলের সাথে চা- সিগারেটের দাম দিতেই শেষ হয়ে যায়। কয়েক জিবি ধারণ ক্ষমতার মেমোরি কার্ড ভরা পর্ন সিনেমা, ছবি আর সাথে গরম মসলা নামের অশ্লীল কিছু ভিডিও গান। মাঝে মধ্যে যে সংসারে কিছু টাকা দেয় না তা নয়। কিন্তু সেটা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।

আরমান আর গুড্ডু অন্য যেকোনো দিনের মতো আজও বসে আছে সেই পান দোকানের বেঞ্চে। শেখ সিগারেট অর্ধেক খেয়ে আরমান গুড্ডুকে বাকিটা এগিয়ে দেয়। আধেক সিগারেট হাতে নিয়ে গুড্ডু আরবের শেখের মতো পরম তৃপ্তিতে টান মারে। ধোঁয়া ছাড়ার আগেই এক চুমুক চা খেয়ে নেয়। তারপর আরাম করে ধোঁয়া ছাড়ে। পাশের রাস্তা দিয়ে নানান রকম গাড়ি চলে যাচ্ছে। দুজনের চোখেই বাহারি সানগ্লাস। সেখানে রাস্তার ছুটে যাওয়া গাড়ির ছবি চলমান সিনেমার মতো ভেসে ওঠে। কোনো এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ের রিকশা যাওয়ার সময় আরমান হা করে তাকিয়ে থাকে। গুড্ডুর মোবাইলে বাজে গান, ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি, করবোই তো...’। মোবাইলের গানের সাথে আরমানের আর গুড্ডুর পা নেচে ওঠে। সুন্দরী তরুণীকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখে আরমান। তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে গুড্ডু বুঝে যায়। আরমান গুড্ডুকে বলে- আরেহ মাদারী, দেখ উহা পার... কেয়া মাল রে দোস্ত! গুড্ডু গলা বাড়িয়ে তাকাতেই তরুণী কিছু একটা বুঝে ফেলে। সে তার ওড়না ঠিক করে। এইভাবে প্রতিদিন তারা দুজন মিলে মেয়েদের দিকে অশ্লীলভাবে তাকায়। আর সুযোগ পেলে বাথরুমে গিয়ে মোবাইল ফোনের সেই সব ভিডিও দেখে হস্তমৈথুন করে।

তাদের বিহারি বস্তির নূরনাহারকে তাদের দুই বন্ধুর জব্বর পছন্দ। কিন্তু নূরনাহার তাদের কাউকে পাত্তা দেয় না। সে এখন ক্লাস এইটে পড়ে এলাকার একটি মাধ্যমিক স্কুলে। স্কুলের উপরের ক্লাসের ছেলেরা তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। নূরনাহারের এই ব্যাপারটা ভালো লাগে। কিন্তু সে যে সমাজের মেয়ে, যেই জাতের মেয়ে, তার কপালে শেষমেশ আরমান বা গুড্ডুর মতো কেউ জুটবে এই নিয়ে সন্দেহ নেই। কেমন করে যেন আরমান এই প্রেমের দৌড়ে এগিয়ে গেলো। সে নূরনাহারকে গুড্ডুর অজান্তে নানান রকম উপহার দেয়। নূরনাহার প্রথম দিকে নিতে চাইতো না। কিন্তু সে জানে, একটু বেশী লেখাপড়া করলেও তার জীবনে এর চেয়ে ভালো ছেলে পাওয়া যাবে না। নূরনাহারের বাবা বিহারি বস্তির রাস্তার উল্টোদিকে একটি ভ্যানগাড়িতে বিরিয়ানি বিক্রি করে। দশ টাকা থেকে বিশ টাকা প্লেট। সন্ধার পর খিদে পাওয়া ক্লান্ত রিকশা ড্রাইভার বা নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ এই সস্তার বিরিয়ানি খেতে আসে। গুড্ডু আর আরমানও আসে মাঝে মধ্যে। তারা নানানভাবে নূরনাহারের বাবার সাথে ভাব জমাতে চায়। নূরনাহারের বাবা এইসব খুব বুঝতে পারে। সে তার ভারী গোঁফের আড়ালে তার রাগ লুকিয়ে রাখে। বিহারি বস্তির সবাই জানে নূরনাহারের বাপ বেশ রাগী মানুষ। যেদিন তার মেজাজ বউয়ের উপর খারাপ হয়, সে পশুর মতো হয়ে যায়। বউ পিটানোতে সে এই বস্তিতে অন্য যেকোনো পুরুষকে ছাড়িয়ে গেছে। লোকটাকে পারতপক্ষে কেউ ঘাটায় না।

কাওয়ালী গানের জলসার রাতে আরমান আর গুড্ডু তাদের বিহারি বস্তির পিছনে খালপাড়ে আড্ডা দিচ্ছিল। আরমান তার মোবাইল ফোন বের করে গুড্ডুকে একটা চমক দেয়। আরমান এরই মাঝে নূরনাহারকে নিয়ে পার্কে ঘুরে আসছে। একটা ছবিতে সে নূরনাহারের কোমর পেঁচিয়ে ধরে সেলফি তুলেছে। সেই সেলফিতে স্পস্ট দেখা যাচ্ছে, আরমানের হাত নূরনাহারের উন্নত বুকের সাথে লেগে আছে। সেইসব ঘোরাঘুরির ছবি গুড্ড দেখে চোখ কপালে তোলে। হিংসায় তার শরীর দিয়ে দ্রুত রক্ত প্রবাহ বয়ে যায়। গুড্ডুর চেহারা মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাশে হয়ে আসে। সে ধানাই-পানাই করে কী একটা কাজ আছে বলে স্থান ত্যাগ করে। গুড্ডু ভাবে, আমিও টেম্পু চালাই, আরমানও টেম্পু চালায়। আমি নিজে একবার চেষ্টা করে দেখি। পরের দিনই গুড্ডু নূরনাহারকে তার সাথে ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। ফলে যা হয়, গুড্ডুকে রাস্তার উপর নূরনাহার অপমান করে বসে। গুড্ডু এই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই সরাসরি নূরনাহারের বাপের দোকানে গিয়ে আরমান আর নূরনাহারের ঘটনা জানিয়ে দিয়ে আসে।

ঘরে ফিরেই রাগী লোকটা নূরনাহারকে বেদম পেটালো। তার চিৎকারে আশেপাশের বাচ্চারাও ভয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলো। যেহেতু একই জায়গায় সবাই থাকে সেহেতু এই ঘটনা ছড়াতে মিনিট দশেকের বেশি লাগলো না। কলিম এর মধ্যে সেদিন সন্ধ্যাবেলা মদ খেয়ে আধা মাতাল হয়ে আছে। নূরনাহারের বাপ এই ঘটনার বিচার নিয়ে আসে কলিমের কাছে। মাতাল কলিম ঘটনা শুনে হো হো করে হেসে দিলো আর বলতে থাকলো- শালা, বহুত আচ্ছা কাম করেছে আমার লাড়কা। পেয়ার করেছে! আচ্ছা করেছে! সে নূরনাহারের বাপকে শায়ের শুনিয়ে দিলো একটা-

“লোগোসে কেহতাহে, কিতাবোমে লিক্ষাহে।

পেয়ার করনেওয়ালা কাভি ডারতা নেহি !

যো ডারতাহে ভো পেয়ার কারতা নেহি!”

মাতাল কলিমুল্লার কথা শুনে নূরনাহারের বাপ তাকে গালি দিয়ে বসলো, ‘সালা শুওর কা আওলাদ’! গালি খেয়ে কলিমুল্লার নেশা যেন হুট করেই ছুটে গেলো। সে বলে উঠলো, ‘কেয়া বলে আপ?? আরে সালা, আমার বাপ এই এলাকার সর্দার ছিলো। তিনটা বাড়ি ছিলো আমাদের। একটা ছিলো দুই তলা। তোর বাপের মতো রেলের বগি ঠেলার চাকরি করতো না কি বে?’

নূরনাহারের বাপ এইবার আরও রেগে যায়, ‘সর্দারের পুত, এখন এই গুয়ের মধ্যে কেন আছিস? এটা তোর পাকিস্তান না বে, এটা বাংলাদেশ আছে। এখানে আমরা বিহারিরা সব এখন এক জাত। বাপ-চাচা লিয়ে কথা বলবি না। আমার লাড়কির সাথে তোর লাড়কাকে ঘুরতে মানা করে দিবি, ব্যাস’! কলিম এইবার যা বলে এতে বোঝা যায় তার সন্তানের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। ‘সালা, জন্ম দিলাম শুওরগুলাকে, এখন কাহাসে কাহতক লায়েক হো গিয়া, নেহি মালুম!’ এদের দুইজনের কথার ভেতরেই বাইরে লোকজনের চিৎকার পাওয়া গেলো। এ খুন! খুন!! নূরনাহারের বাপ আর কলিমুল্লার ঝগড়াটা আর বাড়লো না। দুজনেই প্রায় দৌড়ে গিয়ে দেখলো আরমান জবাই দেওয়া মুরগির মতো বস্তির সামনের খালি জায়গাটায় ধুলাবালিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার বুকের সাদা গেঞ্জি থেকে রক্ত ঝরছে! লোকজনের সামনেই খুনটা হয়ে গেলো। অনেকেই নিজ চোখে দেখেছে ঘটনা। সাধারণ হাতাহাতি থেকে গুড্ডু আরমানের বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে।

হাসপাতালে এক রাত যমের সাথে টানাটানি করে আরমান মারা গেলো। এই বিহারি বস্তিতে এটাই প্রথম খুন না। এর আগেও দুই-তিনটা খুন এখানে হয়েছে। কিন্তু এইবারের খুনে ঘটনা অন্য যেকোনোবারের চেয়ে বেশি ঘোলাটে হলো। আরমান এই এলাকার স্থানীয় ছেলেদের সাথে মিছিলে যেতো। সরকার দলীয় পার্টির ছাত্র নেতাদের পিছনে মিছিলে অংশ নিতো। শুধু সে একাই না, এই বিহারি বস্তির অনেক জোয়ান ছেলেই এইসব মিছিল-মিটিংয়ে সবাই আগে না থাকলেও দল ভারী করার কাজে তারাই এগিয়ে থাকে। এই খুনটা এই অস্থির বিহারি বস্তির মুখরতাকে কেমন যেন পালটে দিলো। কেবল কলিমের বউ আর নূরনাহারের কান্নার শব্দ দিন দুয়েক শোনা গেলো। থানাওয়ালারা প্রথমে যাকে যাকে হাতের কাছে পেলো ধরে নিয়ে গেলো। যে ছাত্র নেতার পেছনে আরমান আর গুড্ডুরা মিছিল দিতো সেই নেতা পরের দিন একটি ব্যানারে শোক বার্তা টাঙিয়ে দিলো।

বিরোধী দলীয় ছাত্র নেতারা কেন বসে থাকবে। তারা গেলো বার যখন ক্ষমতায় ছিলো এই আরমান আর গুড্ডুরাই তো তাদের পেছনে মিছিল দিতো। ফলে তারাও তাদের বিরোধী দলের কর্মী গুড্ডুর ফাঁসি চেয়ে মিছিল করলো। সরকার আর বিরোধীরা মুখোমুখি হয়ে যাওয়াতে পরিস্থিতি সামাল দিতে এক ট্রাক পুলিশ মোতায়েন হলো। কলিমুল্লাহ পোস্টমর্টেম শেষে আরমানকে কবরে রেখেই তার নিজ কাজে গেলো। এমনিতেই দুই দিন কোনো কাজ কাম হয়নি। ছেলের শোক করে না খেয়ে তো মরতে পারে না। কলিমুল্লাহ কাজে যায়। পানির লাইন ঠিক করে, গ্যাসের চুলা বসায়। কিন্তু কাজে তার মন বসে না। এভাবে সপ্তাহখানেক যাচ্ছিল আর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্তও হয়ে আসছিলো। কিন্তু জুম্মাবারে আবার নতুন করে বিপত্তিটা শুরু হয়ে গেলো। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি খুতবা শেষে মাইক নিয়ে যা বলে তার সার কথা হলো, এইখানে বিহারি বস্তিটা এলাকার জন্য চরম এক বিষ ফোঁড়ার মতো। এছাড়া এখানে খুন-খারাবি মারামারি যেভাবে লেগে থাকে সেহেতু এই ভদ্রলোকের এলাকায় তাদের আর এভাবে থাকতে দেওয়া যাবে না। তাদেরকে উচ্ছেদ করতে হবে। সেজন্য এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি করা হবে।

কমিটি করা হলো। সেখানে গণ্যমান্য বলতে এলাকার আমজনতা যাদের দেখতে পেলো তারা কোনো না কোনোভাবে সরকার বা বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি। স্থানীয় সংবাদপত্রে এইসব ঘটনার বিবরণ আসে খুব ছোট করে। বিহারিরা যে জায়গাটায় থাকে সেখানে কম করে হলেও ত্রিশটি প্লট করা যাবে। বর্তমান বাজারে একটি প্লটের দাম কোটি টাকার উপরে। ঘটনা পাক খেতে খেতে স্থানীয় এমপি সাহেবের কান পর্যন্ত গেলো। তিনি শুনে রেগেমেগে একাকার! কারণ, সামনেই ইলেকশান। এখানে প্রায় চারশো ভোটার আছে। বিহারিরা সবাই এখন ভোটার আইডি কার্ড পেয়েছে। এমপি সাহেব পরের জুম্মাবারে খুতবার পরে সেই একই মসজিদে ঘোষণা দিলেন। মাথা ব্যথা হলে মাথা কাটা হতে পারে না। বিহারিরা এখন আমাদের বাঙালিদের ভাই। তারা এখন মূল জনজীবনের সাথে মিশে গেছে। তারা যেখানে যেভাবে আছে সেভাবেই বাস করবে। এই নিয়ে যেন এলাকায় আর অশান্তি না হয়। কলিমুল্লাহ এইসব দেখে আর মনে মনে হাসে আর গালাগাল দেয়। সে জানে এইগুলো সব হারামি, সুযোগ পেলে এই বস্তির মানুষের পাছায় লাথি দিতে দেরি করবে না।

ইলেকশান শেষ হয়ে গেলো। এমপি সাহেব আবার নতুন করে শপথ নিলো। কলিমুল্লাহর দিন বদলায় নাই। সে এখনও মাঝ রাতে মদ খেয়ে রাস্তায় খিস্তি করে বেড়ায়। যেদিন কাজ থাকে আয় করে, আর যেদি থাকে না সেদিন মন খারাপ করে ঘরে শুয়ে বসে থাকে। একদিন সন্ধ্যায় কলিম মন খারাপ করে বস্তির মুখে বসে আছে। একজন লোক রাস্তার অপর পাশ থেকে তাকে ডাক দেয়। লোকটাকে তার চেনা চেনা লাগে। কলিম ভাবে হয়তো এমপি সাহেবের পিছে কোথাও দেখেছে। বয়সে কলিমের ছোট হবে। তবে সে কলিমকে তুই করে বলে, কিরে কলিম? সব ভালো তো?

-ভালো আছি ভাই, আপনি ভালো আছেন?

-আমি ভালো, তুই একটা কাজ করে দিতে পারবি?

-কী কাজ বলেন?

-কাজ খুব ছোট, আবার খুব বড়। তবে কাজটা সোজা। পারবি তো?

-পানির আর গ্যাসের কাজ আমি বহুত ভালা করে পারি ভাই।

লোকটা পকেট থেকে হাজার টাকার কয়েকটা নোট বের করে কলিমকে দেখালো। কলিম চোখের কোণা দিয়ে ঠিক বুঝতে পারে এইগুলো হাজার টাকার নোট। তার দিনমজুর আত্মায় লোভ হয়। কলিম বলে উঠে,

-বলেন কী কাম আছে, আমি এখুনি করে দিবো সাব!  

লোকটা কলিমের চোখ পড়তে চায়। বুঝে ফেলে কাজ হয়ে যাবে। তবুও সে কলিমকে বলে,

-আহারে তোর ছেলেটা অকালে প্রাণ হারালো! বড় মায়া লাগে! আবার দুঃখও লাগে!

কলিম এইবার জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় লোকটার চোখের দিকে। মুখে বুদ্ধির একটা হাসি দিয়ে লোকটি এবার বলে.

-দুঃখ লাগে এই কারণে যে, তুই তোর ছেলের খুনের বিচার পাবি না। এই দেশে গরিবের খুনের বিচার হয় না। আর তুই তো ভিনদেশি, ভিন্ন জাতের, বস্তির কলিমুল্লাহ।

কলিমুল্লাহ সারাদিন কাজ না পাওয়াতে এমনিতেই খুব পেরেশান আর নিজের উপর রাগ। এখন আবার এই লোক এসে তাকে ক্ষেপিয়ে তুলছে আরও। এছাড়া যেদিন কাজ থাকে না সেদিন তার মদ খাবার পয়সাও থাকে না বলে তার মেজাজ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপ থাকে। এখন চোখের সামনে এতগুলো হাজার টাকার নোট আর মাথার ভেতর রোজকার মদের নেশা সব মিলিয়ে বেসামাল অবস্থা।

লোকটা আবার কলিমকে খোঁচায়। কলিম অস্থির হয়ে ওঠে। তার জোয়ান ছেলের লাশ কাঁধে করে সে কবরে দিয়ে এসেছে। এই সব ভেবে নিজেকে বেসামাল লাগে। লোকটি এইবার কলিমকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দেয়। কলিম কাজটা বুঝে নেয়। সাথে হাজার দশেক টাকা লুঙ্গির কোঁচায় সযতনে রেখে সে মদের জন্য বের হয়ে যায়। কলিম তার এই জীবনে এক সাথে দশ হাজার টাকা দেখেনি। সে ভাবনার অন্য স্তরে এখন। মদ খেয়ে একবার বিহারি বস্তির ভেতর ঢুকে পড়ে। তারপর আবার বের হয়ে আসে কিছুক্ষণ পরেই।

গভীর রাতে বিহারি বস্তি থেকে আগুনের চেহারা লিক লিক করে বেড়ে ওঠে। উদ্ভ্রান্ত নারী আর শিশুর কান্না শুরু হয়ে যায় সাথে ছোটাছুটি। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িটা যখন এসে পৌঁছায় তখন বিহারি বস্তির শেষ ঘরটাও পুড়ে ছাই। আগুন লাগার কারণে এলাকার বিদ্যুৎ বন্ধ। আর সেই অন্ধকারে বিহারি বস্তির সেই পোড়া যায়গাটাকে মানুষের লোভ আর হিংসার কালো ছায়ার মতোই লাগে।

রাস্তার কুকুরগুলো আজ আর কলিমের খিস্তি শুনে চুপ করে নেই। তারাও আগুনের চেহারা দেখে ভয়ে অথবা কলিমের কৃতকর্মের কারণে হয়তো ক্ষুব্ধ। কলিম রোজকার মতো কুকুরগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু কুকুরগুলো আজ তাকে দেখে ভীষণ চেঁচাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে বোধহয়। কলিমকে আজ অন্য মানুষ লাগছে। মানুষেরা যা জানে না কুকুরগুলো তা জানে বোধহয়। আর কলিমুল্লা সেই একই লেখার অযোগ্য খিস্তি আওড়াতে থাকে...

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৮
এসএনএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।