ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

জ্যোৎস্না ও একটি পাখির গল্প | মাহফুজুল আলম খান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৫ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০১৮
জ্যোৎস্না ও একটি পাখির গল্প | মাহফুজুল আলম খান প্রতীকী ছবি

আঠারোতেই আমার বিয়ে হয়েছিল।
আমি অত্যন্ত খুশি না হলেও অখুশি ছিলাম; তা বলা যাবে না।
বয়সটা পনেরোর ঘর থেকে ষোলর দিকে যাওয়ার উপক্রম হতেই, আমি যে মা-বাবার ঘোরতর মাথাব্যথার কারণ হয়েছিলাম, সেকথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি।
সংসারের কাজকর্মের ফাঁকে যে মুহূর্তগুলোতে মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়েছি, সেখানে ভয়ানক এক আতঙ্কের ছায়া দেখেছি।

তাকিয়ে দেখতাম ঘুমপোড়া চোখদু’টো। কতরাত ঘুমায়নি কে জানে! মাঝেমাঝে মায়ের পা দু’টো টিপে দেওয়ার সময় দেখতাম, তার শীর্ণ বুকের ধুকপুকানি।

হৃদপিণ্ডের গরাম গরাম শব্দ, আমার কানে এসে বাজত।

কতোদিন মায়ের মুখে হাসি দেখিনি।
মুখটাতে অজানা আশংকা, ভয় ভর করে রাখতো। এই আশংকা, ভয় যখন সবটুকু আমাকে নিয়ে তখন মনে মনে নিজের অস্তিত্বের জন্য নিজেকে বড়ই অস্বস্তিকর মনে হতো। মাঝেমাঝে চাইতাম, বয়সটাকে টেনে-হিচড়ে নিচে নামিয়ে ফেলে, মা-বাবার মলিন মুখটাতে আলো ফুটিয়ে দিই।
কিন্তু সে ক্ষমতা আমার হাতে ছিলো না। মানুষের বয়সটা নিচে নামানো যায় না।

আমার বিয়ে হতে হতে বয়সটা বেয়াড়ার মতো তরতর করে আঠারো ছুঁয়েছিল।
পনের থেকে আঠারো, তিনটা বছর; মা-বাবার বুকের ভেতর চেপে থাকা, দুশ্চিন্তা আর উদ্বিগ্নতার জগদ্দল পাথর সরে যাওয়ায়, আমার অখুশি না হওয়ার কারণ।
  
গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ, জমিতে শাকসবজির ক্ষেত এগুলো চয়নিকা বইয়ের গল্পে তখনকার দিনের বড় বড় গৃহস্থের গৌরবোজ্জ্বল বর্ণনা হিসেবে পড়েছিলাম। আমার বিয়ে হলো ঠিক এইরকম এক গৃহস্থের সঙ্গে।

মা একদিন চুপি চুপি বলল, "নিহান, তোর বিয়ের পাকা কথাবার্তা হয়েছে, লোকটা বড় ভালো মানুষ। একটু বয়স বেশি কিন্তু অনেক বড় গেরস্থ, কোনোকিছুর অভাব নাই, তুই সুখে থাকবি মা”।

মায়ের চোখে তিন-চার বছরের মধ্যে প্রথম খুশির ঝিলিক দেখলাম। এই ঝিলিকের সামনে পৃথিবীর সবকিছুকে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হলো।

শ্বশুরবাড়িতে মাছ আর শাকের ঝোলে তিনবেলা উদরপুরে আহারে কোনো কমতি কখনই টের পাইনি। টের পেয়েছিলাম, আমার গৃহস্থের বয়স আমার চেয়ে আড়াইগুণ বেশি; যা মা বলেছিল, "একটু"।
তবুও সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই।

আমার সংসারের কুলা-চালুনিতে ধান-চাউলের সরাৎ সরাৎ শব্দ, বড় বড় পাত্রে জিয়ানো জ্যান্ত মাছের লেজের বাড়ি, উঠোনে মৌসুমি শাকসবজির ছড়াছড়ি, সবকিছুই আমাকে আশ্বস্ত করত প্রতিবেলার সানকিভরা আহার।

সাদা সাদা ভাতে টাটকা মাছের ঝোল পাতে নিলেই আমি সবকিছু ভুলে যেতাম।
টের পেতাম চোখের কোণে আনন্দ-বেদনার মিশ্র জল চিকচিক করছে।

আমার মনে পড়ত ছোটভাইদের কথা। অনেকদিন ভাইদের মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়াইতে পারিনি। কোনোরকমে জোগাড় করা চাউলে ভাত রান্না হতো। তাতে বাটা মরিচ মেখেই উদরযন্ত্রণার কিঞ্চিৎ প্রশমনের চেষ্টা চলতো।
কখনোই কোনো সকাল আমাকে রাতের খাবারের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত করতে পারেনি। বড়জোর দুপুর পর্যন্তই তার আশ্বাস।
বাবার সারাদিনের খাটুনিতে দুই বেলার চাউলই সাড়া দিত, সেখানে সাদা ভাতের উপর রঙিন ঝোলের আশা, বাবার খাটুনিটাকে অসম্মান করার মতো মনে হতো, তাই মনের চারপাশে ঘুরঘুর করা
সেই আশাটাকে মুহূর্তেই ছুড়ে ফেলতাম। শ্বশুরবাড়ির সংসারটাকে প্রকৃতির দায়-দায়িত্বের মতোই মনে হতো।
কখনই প্রকৃতির নিয়ম থেকে আলাদা করে ভাবার অবকাশ হয়নি।

গোয়াল ভরা গরুতে যেমন প্রকৃতির ইশারায় জীবনচক্রের ধাপ পেরোয়, আমার বেলায়ও তার চেয়ে কোনো অংশে উন্নততররূপ চোখে পড়েনি।
ঋতুর চক্রে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতের মতোই বয়ে বেড়িয়েছি সময়টাকে।

দিনটাকে পাশ কাটিয়ে রাতের কোলে ঢলে পড়া, রাতটাকে কালের গর্ভে ছুড়ে ফেলে আবার দিনের আলোয় ছুটাছুটি- এই ছিলো প্রাত্যাহিক রুটিন।
সময়টাকে কেবল বয়ে চলা।
পুকুরে স্নানের সময় পানির উপর ভেসে থাকা ময়লা যেমন দু'হাতে সরিয়ে ঝপাস করে নিজেকে সপে দেওয়া হয়, তেমনি দিন-রাতগুলোকে দু'হাতে পিছনে ঠেলে, কোনো অজানার কোলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার নিরন্তর চেষ্টায় আমার যেনো কোনো আলসেমি নেই!

মাঝে মাঝে টের পেতাম, আমার মনের চারপাশে ঘুরঘুর করতো কিছু 'অলীক' চাহিদা পূরণের অভিলাষ।
প্রিয় মানুষকে সাথে নিয়ে একটু বেড়ানো, জীবনটাকে কিঞ্চিৎ উপভোগের সুযোগ- এটাই আমার কাছে অলীক।
আমি খেয়াল করতাম, আমার এমন স্পর্ধার চাহিদারা আমার পরিসরের সসীমতা আন্দাজ করে অবলীলায় নুয়ে যেত। তাদের লজ্জাবনত প্রস্থানে, আমার একটা দীর্ঘশ্বাসও সে পথ অনুসরণ করত।
মাছ, মাংস, গরুর দুধ ইত্যাদির মতো উচ্চ খাদ্যমান ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের ভিড়ে, অন্য কোনো 'অলীক' বস্তুর অভাবের বোধোদয়কে কখনই প্রশ্রয় দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। অবশ্য প্রশ্রয় দেওয়ার সে সুযোগও কখনও আমার হয়ে ওঠেনি।

কখনও কখনও বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে, দূর গ্রামের প্রান্তে চোখ আটকে যেত।  
দলবেঁধে একঝাঁক পাখির দিগন্তের দিকে উড়ে যাওয়া দেখতাম। সবুজ ধানক্ষেত, বাঁশঝাড়, নারকেল, সুপারি,
রেইন ট্রি’র সারি পেরিয়ে অনেক দূরের কুয়াশাচ্ছন্ন গ্রামের বুকে হারিয়ে যেত এরা।  
কখনও কখনও শৈশব, কৈশোরের দিনগুলোয় হারিয়ে যেতাম আনমনে। মনের কোলে ভেসে উঠত বাড়ির পাশের সমুদ্রের সেই বিশাল সৈকত। লাল কাঁকড়ার ঝাঁকের পেছনে ছুটোছুটি। ছুটতে ছুটতে দু'একটাকে বাড়িছাড়া করতাম। ছোটখালা একবার লাল কাঁকড়ার ফ্রাই খাইয়ে দিয়েছিলেন। খালা বলেছিলেন, "নিহান, কড়াইতে চিংড়ি ফ্রাই আছে খেয়ে নিস"। খাওয়ার পরে জেনেছিলাম, লাল কাঁকড়ার ফ্রাই। আমার অস্বস্তি দেখে খালা বলল, "কাঁকড়া চিংড়ির মতো। খাওয়া যায়। কাঁকড়া খেলে বেশি দৌড়ানো যায়, সাঁতরানো যায়”। সেটা সত্য কিনা জানি না তবে অবিশ্বাস করার মতো বয়স তখনও আমার হয়ে ওঠেনি। সৈকতের বালিতে পা ডুবিয়ে ঘর বানাতাম, জোয়ারের পানিতে চোখের সামনেই তা তলিয়ে যেত। ঝাউয়ের তলায় বসে কান পেতে শুনতাম বাতাসের সাঁই সাঁই আওয়াজ। এতো আওয়াজ কোত্থেকে আসে? আমার মাথায় ধরে না। এটা নিয়ে মজার খেলায় মেতে উঠতাম। দুই হাতের তালু দিয়ে কান চেপে ধরে আবার একসাথে ছেড়ে দিতাম। একটা সুন্দর তাল পেতাম। আমি মনে মনে যে শব্দটা বলি, কানের মধ্যে বাতাসের শব্দটাও ঠিক যেনো সেটাই বলতো। মা যখন পাটাতে মরিচ বাঁটতেন তখনও এই শব্দখেলাটা খেলতাম। মা মরিচ বাঁটতেন, আমি পাশে বসে মনে মনে একটা শব্দ বলতাম, আর অমনি মরিচ পেষার শব্দটাও যেনো একই কথা বলত।

বৈশাখী ঝড়ের দিনে আম কুড়ানিতে আমার গতি ছিলো ঝড়ের মতোই। ঘরের কোণায় ঝড়ে ঝরা আমের স্তূপে ছোট-খাটো পাহাড় বানিয়ে দিতাম।

বাঁটা কাঁচা মরিচ দিয়ে কাঁচা আমের চান্নি'টা অমৃতের মতোই গোগ্রাসে গিলতাম।

বাড়ির অদূরের পাহাড়টাও ছিলো অতি আপনজনের মতো। বিশাল দেহ নিয়ে গম্ভীর, মৌনতায় দাঁড়িয়ে থাকতো সে।
ঝাঁকড়া চুলের মতো মাথায়, সবুজ গুল্মাদি, বৃক্ষলতার ঘন বন নিয়ে কী মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো!
তার মায়ার পড়ে প্রতিদিনই তার বুকে চষে বেড়াতাম। তার বুক খুটে খুটে পাহাড়ি বুনো ফলে উদর পুরতাম।

জ্যোৎস্না রাতে উঠোনে উঠোনে ছেলে বুড়োদের গ' গ' তে সারা বাড়ি মুখর হয়ে থাকতো।
চাঁদের আলোয় মাছ খেলা, ফুল খেলা, টুপি চুরানি, বউচি, হাডুডু সবকিছুতেই আমার সমান পারদর্শিতা ছিলো।
ধবধবে সাদা জ্যোৎস্নার ভেতর জোনাকির মিটমিটানি সহজে চোখে পড়ে না, একটু আঁধারীর আড়ালে তাদের মেলা বসতো। তাদের মেলায় হানা দিতাম। চার, পাঁচটা জোনাকী ধরে ফ্রকের ভেতর ঢুকিয়ে ঘরে এনে ছেড়ে দিতাম। মাটির প্রদীপের ক্ষীণ আলোয়, আলো-আঁধারীর ঘরটায় জোনাকির আলো স্পষ্ট চোখে পড়ত। সারা ঘরময় মিটমিট করে ঘুরে বেড়াতো জোনাকিরা।

মায়ের চোখে মুখে সহসাই খুশির রেখা ফুটে উঠত।
মা বলতেন, “জোনাকি আসলে ঘরে ভাগ্য আসে, আমাদের ঘরেও সৌভাগ্য আসবে”। সরল অথচ বিশ্বাসের দৃঢ়তা ছিলো মায়ের কণ্ঠে।  

কিন্তু তার সেই সরল-দৃঢ় বিশ্বাসকে সৌভাগ্যেরা বড় বেশি পাত্তা দিয়েছে বলে মনে হয় না। সৌভাগ্যেরা বড় ঘরের বড় বড় লোকদের মনোরঞ্জনেই ব্যস্ত থাকত, গরিব মানুষের ঘরের দিকে তাকানোর সময় কোথায় তাদের? 

আমার গৃহস্থের বেশিদিন নিজের পায়ে অটল থাকার সুযোগ থাকেনি। বিয়ের ছয় কী সাত গ্রীষ্ম পেরোনোর মাথায় পক্ষাঘাত ভর করল তার শরীরে।
আমার সাংসারিকতার প্রতিদিনের রুটিনে যুক্ত হলো স্বামীসেবার নতুন কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক কর্মাদি।
গৃহস্থের উদরপূর্ণকরণ, গতর সাফাইকরণ ও বর্জাদির সদগতিকরণ জাতীয় মহৎ কর্মাদির ভেতর দিয়ে আমার পরিসর আরও ছোট হয়ে গেলো।
আমার নিঃশ্বাস নেওয়া, চোখের পলক পড়াও যেনো রুটিনের ভেতরে, এর বাইরে চোখের পাতা মেলতেই পারি না।  

আজ ভরা পূর্ণিমার রাত।
অনেক দিন হলো জ্যোৎস্না দেখা হয় না। দরজা খুলে বাইরে আসতেই শাদা শাদা জ্যোৎস্নার চাঁট চোখে মুখে পড়ল। বরফ কুচির মতো স্বচ্ছ চাঁদের আলোয় নারকেল পাতার আগায় থির থির কাঁপুনি দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।

বাঁশঝাড়ের মাথায় ঘুমজাগা বকের সাদা ডানাগুলোতে যেনো পিছলে যাচ্ছে জ্যোৎস্নালো। মাঝে মাঝে বকের কড়কড় শব্দ ভেসে আসছে।

ঘরের দাওয়ার উপর ঝোলানো খাঁচাতে ডানা ঝাপটানো পাখিটায় চোখ পড়ল।
আমাদের নয় বছরের পিয়াল পাখিটাকে ধরে এনেছে কোত্থেকে। জোর করে খাইয়ে-দাইয়ে, খাঁচাতে পুরে রাখে সে।

কেমন জানি মায়া হলো তার জন্য। এতো রাতেও সে ডানা ঝাপটায়! যদি ছেড়ে দিই, সে বিশাল আকাশটায় ঘুরে বেড়াবে! জ্যোৎস্নায় গোসল করবে! হাসবে, খেলবে মনের ইচ্ছেমতো।

পাখিরও কি মন আছে, মানুষের মতো? থাকতেও পারে।

পাখিটা হাতে নিতেই সে আরামে চোখ বুজে রইল। মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ছেড়ে দিলাম আকাশের দিকে।

পেঁজা তুলোর মতো জ্যোৎস্না ভেদ করে, দুই ডানায় ভর করে  উড়ে গেলো সে।
যেনো পুরো আকাশটাই তার।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৮
এসএনএস/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।