ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কুসংস্কারবিরোধী লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ | নীল রফিক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৭
কুসংস্কারবিরোধী লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ | নীল রফিক কুসংস্কারবিরোধী লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ | নীল রফিক

১০ অক্টোবর বাংলা কথাসাহিত্যের স্তম্ভপ্রতিম কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ গভীর রাতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান। তার আকস্মিক মৃত্যু বাংলাদেশ তথা বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জন্ম নেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট। কিন্তু কাগজ-কলমে রয়েছে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর।

পিতা সৈয়দ আহমাদউল্লাহের সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকার সুযোগ হয়। বিভিন্ন পরিবেশ আর মানুষের আচার-আচরণ প্রত্যক্ষ করে তার মনো-স্বাধীনতা ও কুসংস্কারহীন মানস তৈরি হয়।

এ ব্যাপারে তার বড় ভাইয়ের একটি মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো, ধর্মান্ধতাই বাঙালি মুসলমানের অধঃপতনের কারণ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের মা নাসিম আরা খাতুন উচ্চশিক্ষিত, রুচিশীল পরিবার ও বনেদি বংশের নারী ছিলেন। যদিও ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সে তিনি মারা যান, তবুও ধারণা করতে পারি মায়ের প্রভাব সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের মধ্যে ছিলো। তার সাহিত্যিক প্রেরণার মানস গঠন হয়েছিল মায়ের ভিতর দিয়ে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা সাহিত্যে যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, যতোটা আলোচিত, যতোটা সমালোচিত, যতোটা সম্মানিত তা তিনি অর্জন করেছেন রচনার সংখ্যা দিয়ে নয়, রচনার শিল্পসম্মত অভিনবত্বে। তার উপন্যাসের সংখ্যা তিনটি- লালসালু, চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো। নাটকের সংখ্যা চারটি- বহিপীর, তরঙ্গভঙ্গ, সুড়ঙ্গ ও উজানে মৃত্যু। গল্পগ্রন্থ দুইটি, নয়নচারা এবং দুই তীর ও অন্যান্য গল্প। এছাড়া কিছু অগ্রন্থিত গল্প রয়েছে। সাহিত্যকর্ম বেশী না হলেও আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্য তাকে ছাড়া কল্পনা করা যায় না। বাংলা সাহিত্যে যখন থেকে লেখা শুরু তখন তার লেখনি শক্তির চাপে অনেক লেখকের লেখা চাপা পড়ে যায়। দেশবিভাগের পর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের বাড়িতে আশ্রয় নেন তারই রাজনৈতিক সঙ্গী কবি ও সাহিত্যিক গোলাম কুদ্দুস। এইসময়ে একদিন তার বাড়িতে নিজের দ্বিতীয় উপন্যাস 'সামনে নতুন দিন' নিয়ে আসেন আবু রুশদ। গোলাম কুদ্দুস আবু রুশদের প্রথম উপন্যাসের দীর্ঘ আলোচনা লেখেন। এ অবস্থায় আবু রুশদ যখন নিজের উপন্যাস তাকে সমালোচনার জন্য শোনাতে যান তখন গোলাম কুদ্দুস বলেন, 'ওসব লেখা আমি এখন পড়ি না, আর এখন ওয়ালীউল্লাহর লেখা শুনছি, অন্য কোনো উপন্যাস শোনার সময় নেই’।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সেসময়ে এতোটাই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন। আর এখনও সেই গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। যতো দিন যাচ্ছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের আলোচনা ততো বাড়ছে এবং আলোচনা যতো বাড়ছে পাঠকের সংখ্যাও ততো বাড়ছে। তার সাহিত্য কতোটা গ্রহণযোগ্য সে বিচার করবো না, শুধু বলবো তার লেখা পাঠকের কাছাকাছি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এর কারণ, সময়-উত্তীর্ণ বিষয় আর চরিত্র। তার চরিত্রগুলো আমাদের খুব চেনা-জানা। যে বিষয়গুলো আমরা জানি কিন্তু বলতে পারি না বা বলার ভাষা খুঁজে পাই না তখন যদি কেউ সেই বিষয়কে ভাষা দিয়ে কাহিনী বানিয়ে বলতে পারে তা আমরা মনযোগ দিয়েই শুনবো। আর এই বলার কাজটাই করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। মজিদ ও বহিপীর চরিত্র বা আরেফ আলী মাস্টার ও জজ সাহেব চরিত্র— এসব চরিত্র সৃষ্টি করেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বিখ্যাত।

তিনি আমাদের সরাসরি বলেননি কোনটা ঠিক কোনটা ঠিক না। কিন্তু আমরা বুঝে নিয়েছি- প্রথমেই বলেছিলাম, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কুসংস্কারবিরোধী লেখক। ধর্মের নামে ভণ্ডামি বা ধর্মীয় গোঁড়ামিকে তিনি সাহিত্যে তুলে এনেছেন চরিত্রের মাধ্যমে আবার বিপরীত চরিত্রও তৈরি করেছেন কুসংস্কার থেকে উর্ত্তীণের পথ দেখাতে। লালসালু উপন্যাসে এমন কুসংস্কারের প্রতীক মজিদ আর কুসংস্কার বিশ্বাসী রহিমা। কিন্তু জমিলা এসেই যেনো এই কুসংস্কার বা মজিদের ভণ্ডামির পায়ে আঘাত করল। তেমনিভাবে বহিপীর নাটকে বহিপীর মজিদেরই প্রতিচ্ছবি আর জমিলার প্রতিবাদী রূপ তাহেরা। যেখানে জমিলার মধ্যে আমরা নীরব চরিত্রের সাক্ষাৎ পাই, সেখানে তাহেরা প্রকাশ্য প্রতিবাদ করে নারী জাগরণ তথা নতুনের আভাস দেয়। বিংশ শতকের নারী জাগরণের প্রতীক তাহেরা যার মাধ্যমে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আধুনিকের আহ্বান আর কুসংস্কারের বিরোধিতা করেছেন। এসব চরিত্রকে দেখলেই বোঝা যায় তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তার প্রতিটি চরিত্রই যেনো সমাজ, দেশ ও কালকে প্রতিনিধিত্ব করে। প্রকৃতিই যেনো তার চরিত্র আর তাই তা জীবন্ত ও বাস্তব। যতোদিন যাবে সমাজ থেকে তৈরি তার জীবন্ত চরিত্রগুলো আরও বাস্তব হবে এবং বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আরও বেশি আলোচিত হবে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় এই মহান লেখক স্বাধীন দেশটাকে দেখে যেতে পারেননি। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্যারিসে ছিলেন এবং সেখানে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালান, জনমত তৈরি করেন এবং কলকাতা মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে আর্থিক সাহায্যও পাঠান।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই মাস আগে অক্টোবরের ১০ তারিখ পেরুর নিজ বাসভবনে মারা যান। তার মৃত্যুতে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয় তা কখনই পূরণ করা সম্ভব নয়। তবে স্বাধীন দেশকে তিনি যতোটা চেয়েছেন তিনি ততোটা পাননি। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার ছাত্রজীবনের বন্ধু পরবর্তীতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, আবু সাঈদ চৌধুরী সৈয়দের মৃত্যুর সাত মাস পরে তার স্ত্রীকে একটা আধা সরকারি সান্ত্বনাবার্তা পাঠিয়েছিলেন।

তাতে লেখা ছিলো, “আমাদের দুর্ভাগ্য যে, মি. ওয়ালীউল্লাহর মাপের প্রতিভার সেবা গ্রহণ থেকে এক মুক্ত বাংলাদেশ বঞ্চিত হলো; আমাকে এটুকু বলার সুযোগ দিন যে আপনার ব্যক্তিগত ক্ষতি বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষতি”।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, তার সন্তানেরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাননি। আজকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে গভীরভাবে স্মরণ করি এবং আশাবাদ ব্যক্ত করি, তিনি যে চেতনা নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন সেই চেতনা আমাদের মাঝে জাগ্রত হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।