ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

মনের ঘূর্ণি থেকে-৩

কাজল-কালো | তানিয়া চক্রবর্তী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৭
কাজল-কালো | তানিয়া চক্রবর্তী কাজল-কালো চোখ

হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন আজকের বিষয়বস্তু কাজল। সেই রেখা বা আগুনে পোড়ানো সেই ভাষা যা রহস্যের দেহ উন্মোচনের জন্য ডাকে। আমাদের জীবন যখন একা অতিবাহিত হয় তার ভাব এক, যখন দোকা বা তার বেশিভাবে অতিবাহিত হয় তখন তার ভাব আরেক অর্থাৎ সমাহারে প্রকাশিত রূপ। সেরকমই কাজল ছাড়া চোখ আর কাজল পরা চোখ। কাজল চোখের সেই সঙ্গিনী যা তার রূপকে বহুমাত্রিক করে তোলে। চোখ জীবনের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় ছাড়াও বহুদিক দিয়ে অর্থ বহন করে— একটা স্থির চোখ একটা প্রহেলিকা।

প্রাচীন রোমের বিখ্যাত শিল্পী ও দার্শনিক প্লিনি দ্য এল্ডারের মতে, “That eyelashes fell out from excessive sex and so it was especially important for women to keep their eyelashes long to prove their chastity”। আজব হলেও এই ছিলো সেইসময় প্রসাধনী ভাবনার ভূমিকা।

কাজলকে মেয়েরা প্রধানত প্রসাধন সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করলেও শিশু এবং কিছু পুরুষের মধ্যেও এর বিশেষ চল আছে। ইসলাম ধর্মে নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই সাগ্রহে এর ব্যবহার রয়েছে। ইসলাম ধর্মে বিশেষ উৎসব রমজানে সপ্তাহের বিশেষ বারে সুরমা (কাজলের আর এক রূপ সম্পর্কিত নাম) পুরুষেরা চোখে লাগায়, এ এক পবিত্র আচার তাদের কাছে। প্রবর্তিত নিয়ম অনুযায়ী, ডানচোখে তিনবার বামচোখে দু’বার এই ভাবে লাগানোর নিয়ম তারা পালন করে। পাঞ্জাবিরা তাদের বিশেষ উৎসবে এর ব্যবহার করেন, পুরুষেরা বিশেষত তার মা কিংবা স্ত্রীর হাতে চোখের আশেপাশে একে ব্যবহার করেন। আর আফগান পুরুষরা তো এটিকে একটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহার করেন। চতুর্থ শতাব্দীর কাজল রাখার পাত্র
বেদুইন পুরুষেরা এর ব্যবহার করতেন, এখন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল খেলোয়াড়রাও এর ব্যবহার শুরু করেছেন খেলার সময়। কাজলের ব্যবহারে সবচেয়ে প্রাচীন হলো ইজিপ্ট। কাজলের ব্যবহার যে জায়গায় সবচেয়ে বেশী শুরু হয় তা হলো মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া। ইজিপ্টের প্রোটোডাইন্যাপ্টিক সময় খ্রি. পূ. ৩২০০ সালে সম্ভবত এর ব্যবহার শুরু হয় প্রচলিত অর্থে। সেখানকার রানী ও মহৎ নারীরা তা ব্যবহারের যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। প্রাচীন ইজিপ্টবাসীদের কাছে ভালোবাসা ও সৌন্দর্য্যের প্রকাশ তারা শিল্প ও মরদেহের সজ্জার মাধ্যমে প্রকাশ করে। এই কারণে দেখা যায় তারা মমি তুতেন খামেনের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন প্রসাধনীর কারুকার্য ছাড়াও কাজলের মাধ্যমে চোখের নাটকীয় শিল্প এঁকেছেন। এখানে নারী-পুরুষ সবাই একধরনের চোখ আঁকতেন কাজলের মাধ্যমে তা হলো, চোখের নিপরে-নিচের রেখায় কাজলের লাইন টানা এবং নিচের লাইন থেকে আমন্ড বাদামের মতো অংশ আঁকা যা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ। তারা এও মনে করতেন, শয়তানের দৃষ্টি, অসুস্থ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া কাজলের মাধ্যমেই সম্ভব। তারা শনি গ্রহের অবস্থান ইত্যাদি বহু কিছু মেনে লেড সালফাইড থেকেই প্রধানত কাজল প্রস্তুত করতেন। কিন্তু ২০১২ সাল নাগাদ বস্টনের একটি শিশু হাসপাতালে প্রমাণিত হয়, অতিরিক্ত লেড সালফাইড পূর্ণ কাজল ব্যবহারের জন্য লেডের বিষক্রিয়া শুরু হতে পারে। এই কারণে যুক্তরাষ্ট্রে এর ব্যবহারের লেড উপাদান সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। ভারতবর্ষে অবশ্য এর বিকল্প পদ্ধতি দিয়েই কাজল বানানোর প্রথাকে নেওয়া হয়েছে সেখানে স্বল্প পরিমাণ লেড ব্যবহারের মাধ্যমে নাইট্রিক অক্সাইড উৎপন্ন করে চোখের অনাক্রমতা শক্তিকে বাড়ানো যায় বাস্তবিক অর্থেই। প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতে শুধু চোখে নয় চোখের উপরে-নিচে পাতায় এর ব্যবহার করা হতো। সেখানে এক্কাডিয়ান ভাষায় একে বলা তো ‘গ্যালেনা আই পেন্ট’। কাজল-কালো চোখ
কাজল শব্দটি হিন্দি, বাংলা, গুজরাতি, সংস্কৃতে ব্যবহৃত। মারাঠিতে কাজলাহ, তেলেগুতে কাটুকা, তামিলে কন মাই। পাঞ্জাবি ও উর্দুতে এটি সুরমা নামেই ব্যবহৃত। কাজল ব্যবহার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন ক্লিওপেট্রা এর ব্যবহার শুরু করেন। এর ব্যবহার শুরুর উদ্দেশ্য অবশ্যই প্রসাধন কিন্তু এই প্রসাধনের গন্তব্য শুধু শিল্পভিত্তিকভাবে সৌন্দর্য্য বাড়ানো নয়, এর ব্যবহারের মাধ্যমে তারা মনে করতেন “কুনজর (evil eye)” থেকে তারা রক্ষা পাবেন। এবং আরও মনে করা হতো, চোখের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এটি সম্ভবত একটি প্রক্রিয়া। তাই পরবর্তীতে লেড সালফাইড অর্থাৎ গ্যালেনার সঙ্গে চন্দন কাঠ কিছু ভেষজ তেল ব্যবহার করেও এটি তৈরি করা হয়। আরও মনে করা হয়, চোখকে যে কোনো খারাপ রশ্মি থেকে সূর্যের আলোর খারাপ প্রভাব থেকে এই কাজলই উদ্ধার করে। পরবর্তীতে অবশ্য বিজ্ঞান এর আরও ভালো-মন্দের দিক তুলে এনেছে। অদ্ভুত এর প্রভাব, কাজলে রাঙানো চোখ পুরুষকে আকর্ষণের দিক হিসেবে যেখানে তুলনা করা হয় সেইখানেই কিছু দেহব্যবসার মেয়েরা এর মাধ্যমে একটি সীমানা নির্ধারণ করেন। সম্প্রতি একটি ব্লগ পড়ে জানতে পারি, মুম্বই শহরে কামথিপুরার দেহব্যবসায়ী মেয়েরা অনেকসময় তাদের ঠোঁটের চারপাশে কাজল দিয়ে যেনো একটি নিষিদ্ধ সীমা তৈরি করে, স্বাভাবিকভাবেই ঠোঁটের এই রূপ তাদের সুন্দরের বদলে খারাপ দেখতে করে তোলে। এখানে তারা কারণ হিসেবে বলেছেন, পুরুষেরা আসে দেহ নিতে প্রেম নিতে নয় অতএব ঠোঁটে চুম্বন এটি তারা তাদের করতে দেয় না। তারা যাতে এটা না করে তাই এই মেয়েরা ঠোঁটের আকর্ষণ কমানোর জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করেন। মিশরবাসীরা প্রসাধন সামগ্রী সম্পর্কে সবসময় একটু ব্যতিক্রমী। এখানেই কসমেটিক্সের ব্যবহার প্রথম যত্নের সঙ্গে শুরু হয়। তারা চোখে কাজল লাগিয়ে আয়নায় তা দেখে হোরাসের ধর্মীয় ভাবনাকে কায়েম রাখত। আর মনে করত এই প্রথাই তাদের সম্পদ রক্ষার পথ। ইংরেজি kohl শব্দ এর আবির্ভাব আরবি শব্দ kuhl  থেকে। ভারতবর্ষের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নৃত্য ভারতনাট্যম ও কথাকলির প্রসাধনে কাজল বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। মা তার সন্তানকে কাজলের টিপ দেন যেনো তার প্রতি খারাপ দৃষ্টি না পড়ে। এই ভাবনা ভারতবর্ষে কাজল ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিশেষ ভাবে বিদ্যমান। কাজল-কালো চোখ
যেসব অঞ্চলে বা ধর্মীয়ভাবে নারীর মুখ আচ্ছাদিত থাকে সেখানে চোখ একমাত্র প্রসাধনের ও ভাবভঙ্গির অঙ্গ। সেখানে চোখের সজ্জা তাই একমাত্র ও জনপ্রিয় জিনিস। এই চোখ সেখানে মুখ, ঠোঁট, হাসি সমস্ত অনুভূতির মাধ্যমের একক হয়ে যায়। তাই বোধহয় সুইডিশ ভাষার অন্যতম প্রবাদ হলো, “The eyes are the window of the soul”। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন বলেছেন, “The eye of the master will do more work than both his hands”।

বিখ্যাত মার্কিন চিত্রপরিচালক আলফ্রেড হিচকক বলেছেন, “Dialogue should simply be a sound among other sounds, just something that comes out of the mouths of people whose eyes tell the story in visual terms”।
 
অতএব এই মহার্ঘ্য চোখের আভিজাত্যের উপাদান হলো কাজল। যা চোখকে মহিমায় ভরিয়ে রাখে তা অস্বীকারের উপায় নেই। আমাদের ছবি কিম্বা সিনেমার দৃশ্য যেখানেই হোক কাজলে এক অদ্ভুত উপাদান যা ভাবকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যায়। কোনো ভিলেনের দৃশ্যকে উগ্র করে তুলতে কাজল, কোনো নায়িকার ভাবতরঙ্গকে মসৃণ করতে কাজল। আসলে চারিদিকে এখন আমরা যে বডি আর্টের কথা শুনি তার ভূমিকাজুড়ে নিশ্চয় কাজল। এই কাজল চোখ দেখে আমাদের ভয়, রহস্য ঘনীভূত হয়েছে মনে। এই কাজল চোখই প্রেমের বাতাবরণকে প্রশ্রয় দিয়ে নিয়ে গেছে কবিতার ভেতরে, আঁকার ভেতরে। কাজল মনে হয় সেই লিপি যা অক্ষর না দেখিয়েও এক বিদগ্ধ ভাষা তৈরি করে...।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫০২ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।