ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

গল্প

বহেরাতলার বটগাছ | শতীষ চক্রবর্তী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০১৭
বহেরাতলার বটগাছ | শতীষ চক্রবর্তী বহেরাতলার বটগাছ

সেবার চৈত্রের রোদে পুড়ে, বৈশাখের বৃষ্টিতে ভিজে ফের জ্যৈষ্ঠের রোদে পুড়ে বহেরাতলা গ্রামের চার কুড়ি মানুষ আত্রাই নদীতে বাঁধ দিয়েছিলো। লম্বাটে গ্রামের একপাশ পুরোটা জুড়ে নদী। তিন মাসের কর্মযজ্ঞ! একদিকে কাজের জোগাড়, অন্যদিকে গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে যাবে রেলগাড়ি- সে এক অন্য রকম উত্তেজনা। কাজ চলছিলো জোরছে; কেবল বটতলায় এসে কেমন যেনো গতি হারিয়েছিলো।

দশ বর্ষা আগেও ওই প্রকাণ্ড বটগাছটার ওপারে ছিলো বহেরাতলা মহাশ্মশান। পাকা থানের চারিপাশে চোখ আটকানো জঙ্গল।

সরু পায়ে হাঁটা প্রবেশ পথের দু’পাশে বাঁশ, বাংলা কলা গাছের সারি। নদীর পাশে ছিলো প্রায় অর্ধশত সমাধি। মাঝে মাঝে দেবদারু, তাল, নারকেল, সুপারি গাছ। শ্মশান থেকে দেড় মাইল দূরে গ্রামের শেষ বাড়ি। তিনকড়ি বাগচীর।

মাঝ বর্ষার এক রাতে আত্রাই ভাসিয়ে নেয় সব সমাধি। আগের দিন সন্ধ্যায় শুরু হয়ে ঝুম বৃষ্টি চললো পরদিন সন্ধ্যা অব্দি। দুপুর নাগাদ শ্মশান থানও চলে যায় আত্রাইয়ের পেটে। অদ্ভুতভাবে ভাঙনটা ওই বটগাছটার কাছে এসে দিক পাল্টায়!
ঘরের খুঁটি লাগানোর সময় তিনকড়ি বাগচীই প্রথম দেখতে পায় গ্রামের শ্মশান নদী ভাঙনে মিলিয়ে গেছে।

ভয়তো লোকালয়ে! মৃত্যুর ভয়, হারানোর ভয়, ব্যথা পাওয়ার ভয়। এগুলো জয় করেই তো মায়ের কোলে আসতে হয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, সাধ, আহ্লাদ, ক্রোধ, হিংসা, লোভ মিটলে তবেই তো পাওয়া যায় মায়ের আশীর্বাদ- এমন বাণীতে প্রভাবিত হয়ে একদিন মৃণাঙ্ক ঘর ছেড়ে শ্মশানে আশ্রয় নেয়। বহেরাতলায় রটে যায় তার নিখোঁজ হবার সংবাদ।

দিনের বেলাটুকু তার কেটে যেতো সমাধির ভেতর, লাশের পাশে। সন্ধ্যা নামলে পাকা থানে এসে বসতো মৃণাঙ্ক। মাঝে মাঝে সাপ তাড়াতে লাঠি লাগতো ঠিকই, তবে শেয়াল তাড়াতে শেয়ালের ডাকই ছিলো তার অস্ত্র। জোঁক, শুঁয়োপোকা এর চেয়েও বেশি ছিলো মানুষের ভাবনা- তবু ভালো! হাসি কেবল আনন্দ দেয় না; আতঙ্কও ছড়ায়। একটা সুবিধা বরাবরই ছিলো, বেলা পড়ে এলে শ্মশানমুখো হতো না কেউ।

গ্রামের অর্ধশত না মরে বেঁচে থাকা বুড়া-বুড়ির সময়তো ফুরাবারই ছিলো। এছাড়া ওলাওঠা, কালাজ্বর, কলেরা, বসন্ত: এ মৃত্যুর মিছিল থামার না। লাশের সাথেই আসতো পোশাক, মিষ্টি, শুকনো খাবার। দিব্যি চলে যাচ্ছিলো মৃণাঙ্কের নিরুত্তাপ জীবন।

বেশি সময় লাগেনি! এক মাসে মৃণাঙ্কের অট্টহাসি হয়ে যায় তার মৃত্যুর পরিষ্কার প্রমাণ।  
-মৃণাঙ্ক আত্মহত্যা করেছে। তার অশান্ত আত্মা শ্মশানে ঠাঁই নিয়েছে। সন্ধ্যার পরে, গভীর রাতে, শোনো না তার হাসি?
-হ্যাঁ। গলাতো ওঁরই!
-কিন্তু ওঁর লাশ কোথায়? আর কীভাবে মরলো?
-হুমম। বাচ্চা-কাচ্চা তো ছিলো না। বুড়াকালে বৌটাও নৌকাডুবে মরলো।  
-হরি, হরি! কার ভাগ্যে কখন কী হয়!
-খারাপই লাগে মৃণাঙ্কের জন্য।
-সত্তোর ছুঁই ছুঁই, এ বয়সে নরকের পথে গেলো!

অবশ্য, মৃণাঙ্কের মৃত্যুই হয়েছিলো। পার্থক্য হলো শ্বাস বন্ধ হবার আগে সবাই তা টের পায় না। সে পেয়েছিলো। আক্ষেপ কীসের? কতই-বা, বড়জোর আর দশ-পনেরো বছর বাঁচতো সে। প্রাপ্তি বিয়োগ, অপ্রাপ্তি যোগ: কখন রাজ কপাল কালসর্পযোগে পথে পথে হয়ে যায়, সে তো আজও প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের মতোই রয়ে গেছে।

কৃষ্ণা দ্বাদশীর রাতে শ্মশানের পাকা থানে শুয়ে মৃণাঙ্ক ভাবছে জীবন কী? কেমন হয় অনেক চাওয়া মানুষের জীবন? অমাঅন্ধকারে ক্ষুধার্ত শেয়ালের জ্বলে ওঠা চোখের মতো, নাকি তার সমাধি খোঁড়া ধারালো নখের মতো? না তার দাঁতের মতো! আর শুধু জীবন? চামড়া, মাংস পচে যাওয়া পঞ্চানন শুকুলের কঙ্কালের মতো? তার চোখহীন খুলির মতো? জীবনও কি একা মানুষকে শেয়ালের মতো চারদিক থেকে ঘিরে থাকে!

মৃণাঙ্ক কাপুড়িয়া তো দোলার খুশি ছাড়া কিছুই চাইতে শিখলো না কোনোদিন! কিন্তু চাওয়া পর‌্যন্তই। দোলার শেষ ইচ্ছা ছিলো ট্রেনে চেপে চন্দ্রনাথের মন্দির দেখতে যাবে। চোখ ছলছল করে ওঠে তার...

বহেরাতলা স্টেশনেও আজকাল ট্রেন দাঁড়ায়। অনেক অনেক অচেনা মুখ জানালায় জানালায়। আসে, যায়। তিনকড়ি বাগচীর বাড়ির পাশেই হয়েছে জমজমাট মোকাম। সেখানে তার একটা চায়ের দোকানও আছে। বাপ-ছেলে মিলে বেশ করে খাচ্ছে। গৌড় স্কুলে ভালো করতে না পারলেও ব্যবসাটা ঠিকই বোঝে। গ্রামও আর সে গ্রাম নেই! তিন বছরে পাল্টে গেছে সব। বাজার ঘেঁষে রেল পুলিশের অফিস। পুলিশের বড়কর্তার সাথে গৌড়ের খুব ভাব।

সেই বর্ষার রাতেই রেল ফাঁড়িতে তলব পড়লো গৌড়ের। দৃষ্টি নামে এক গৃহবধূ চলন্ত আন্তঃনগর ট্রেন থেকে পড়ে মারা গেছে। দরজা থেকে পড়ে সোজা চাকায়। সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সময় খোঁজ হয় গৌড়ের। মোকামের পাহারাদার মোহন এসে জানায়, এক লোক ওই মহিলাকে হাত ধরে টান দেয়। ট্রেনের ক্যান্টিন বয় বাদলও একই কথা বলে! বাদল এবং মোহন দু’জনই ফাঁড়িতে উপস্থিত।

বাদল: দাড়ি-গোঁফ নেই, মাথায় চুল নেই, চোখের পাঁপড়ি নেই, ভ্রু পর‌্যন্ত নেই! সাদা থান জড়ানো শরীরে। বৃদ্ধ। খালি পা। রাতের অন্ধকারে এর বেশি দেখতে পাইনি। খাবার দিতে এসে এটুকুই দেখতে পেয়েছিলাম। দৃষ্টি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো। চিকেন কাটলেট আর তার স্বামী লাল চা অর্ডার করেছিলো।

গৌড়: স্যার, এ গ্রামে এ রকম দেখতে কেউ নাই।

এক সপ্তাহ ব্যবধানে এক মাসে তিনটা দুর্ঘটনা। একই জায়গায়, একইভাবে মৃত্যু। প্রথমে দৃষ্টি, এরপর রুবি, সব শেষে সোমা। একই অভিযোগ। রাতের ট্রেনের ক্যান্টিন বয়, রেল নিরাপত্তাকর্মী অনেকেই দেখেছেন বটতলায় ওই অপরিচিত লোকটিকে বসে থাকতে।

বিস্মৃতি থেকে আবার উঠে আসে সেই নাম। মৃণাঙ্ক কাপুড়িয়া। গ্রামের নতুন শ্মশান এখন পূর্ব দিকে। পাশে কালী মন্দির। নদীর ভাঙনের পর দীর্ঘদিন ওই নাম কারও মনে আসেনি।

“রক্তশূন্য ফ্যাকাসে চেহারা। মাছের মতো শীতল চোখ, স্থির। মাথায় চুল নেই। চোখে পাঁপড়ি নেই। ভ্রু নেই। ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে গেছে- ফাঙ্গাস পড়া। হাড়ের ওপর পচন ধরা চামড়া। সাদা থান জড়ানো বৃদ্ধ। খালি পা। হাতে পায়ে নখ যেনো পচে ভেঙে ভেঙে গেছে। বটগাছটার নিচে দুই লাইনের মাঝখানে খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। ঝিকঝিক শব্দ তুলে ট্রেনটা কাছে আসতেই দৃষ্টির হাত ধরে টেনে নেয়! লাল কাতান পড়া মেয়েটা মুখ থুবড়ে পড়ে লোহার চাকার তলায়। ” 

এ ঘটনা চোখে দেখেছে মোহন। খুব কাছ থেকে। এরপর থেকেই কেমন বিষণ্ন হয়ে গেছে। কথা বলে কম। চুপ করে থাকে। এক মাস আগে সেই কথা বলেছিলো থানায়। তারপর থেকে চুপ।

আজকাল তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায় মোকাম। ইশার প্রথম কাতার পূরণ হয় না মসজিদে। সন্ধ্যা সন্ধ্যা দরজায় খিল পড়ে যায়। জুমাবার; মাগরিবের পরেই যেনো বহেরাতলায় নিশুতি পড়ে গেছে! ভোরবেলা চাউড় হয়ে গেলো মোহনকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাতে দরজা খুলে বের হয়ে গেছে, বাড়ির কেউ টের পায়নি। গৌড় বিষয়টা রেল ফাঁড়িতে জানানো দরকার মনে করে সেদিকে যাচ্ছিলো। সঙ্গে নীপেন, তারাপদ, শ্যামসুন্দর, নিখিল। মোকামের কাছে পৌঁছাতেই সবার পা একসাথে থেমে গেলো। বটগাছে ঝুলছে মোহন! গলায় ফাঁস দিয়েছে।

রেলপুলিশ, থানা পুলিশ সুরতহাল শেষে লাশ পাঠালো নওগাঁ সদর আধুনিক হাসপাতালে। ময়নাতদন্ত শেষে সৎকারের ব্যবস্থা হতে হতে রাত। বলো হরি- হরিবোল/ বলো হরি- হরিবোল/ বলো হরি- হরিবোল/ অপঘাতে প্রাণ গেলো মোহনের!

মৃণাঙ্ক কাপুড়িয়ার হাসি থেমে গেলেও আজও থামেনি মোহনের বাঁশি! প্রতি জুমাবার দিনগত গভীর রাতে বহেরাতলার অলিতে-গলিতে শোনা যায় মোহনের বাঁশির করুণ সুর।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৮, ২০১৭
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।