ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

সাহিত্যের অমর প্রতিভা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৭
সাহিত্যের অমর প্রতিভা সাহিত্যের অমর প্রতিভা হুমায়ূন আহমেদ

নন্দিত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ দূর-পরবাসে লোকান্তরিত হয়েছিলেন ১৯ জুলাই। ৫ম মৃত্যুবার্ষিকীতে জনপ্রিয় লেখকের বেদনার্ত শেষ দিনগুলো ফিরে দেখেছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর কন্ট্রিবিউটিং এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজ

২১ জুলাই, শনিবার বাংলাদেশের মিডিয়া ছিল হুমায়ূনময়। কিন্তু আবেগ ও উচ্ছ্বাসের তোড়ে ব্যক্তিক ও নৈব্যক্তিক ভারসাম্যে হুমায়ূনের মূল্যায়ন হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনেকেই বিস্মৃত হলেন।

সাহিত্যে ও কর্মে তিনি যে চিরদিন বেঁচে থাকবেন, সেটা বিশ্লেষণে ওঠে আসা প্রয়োজন।  

আমার মনে হলো, ব্যক্তি হুমায়ূনের মৃত্যু হলেও লেখক, নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ মারা যাননি। আমি তার কীর্তির মূল্যায়ন করে অনুভব করি সাহিত্যের অমর প্রতিভা হুমায়ূন আহমেদকে। ততক্ষণে সাহিত্যে তার অমরত্বের বিষয়টি প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় স্পষ্ট হতে থাকে।  

অন্যদিকে তোড়জোর চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দেশে আনার। মৃত্যুর কফিনে জীবনের সিম্ফনি গাইতে গাইতে আসছেন মৃত্যুঞ্জয়ী হুমায়ূন আহমেদ।  

সোমবার (২৩ জুলাই) তিনি নিউইয়র্ক থেকে আরও সঙ্গে নিয়ে আসবেন ‘হিমুর হাতের কয়েকটি বেদনার্ত নীলপদ্ম‘। ভালোবাসার মহানায়কের এই বিষাদসিক্ত প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় তখন সমগ্র বাংলাদেশ ও বিশ্বের সকল বাংলাভাষী মানবমণ্ডলী।

আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ একবছর আগে (২০১১) মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনিবার্য মৃত্যুর সামনে। কিন্তু তিনি মৃত্যুর অপেক্ষায় ছিলেন না। ছিলেন জীবনের উচ্ছ্বাসে ও প্রত্যাশায় ব্যাকুল। অবিরাম জীবনের জন্যে যুদ্ধ করে গেছেন; উজাড় করে দিয়েছেন নিজেকে আর নিজের ভালোবাসাকে।  

বাংলা নাটক কিংবা চলচ্চিত্রেও নতুন দর্শক সৃষ্টি করেছেন হুমায়ূন আহমেদগড়তে চেয়েছেন ক্যানসার হাসপাতাল। উত্তরাধিকারীদের হাতে নুহাশ পল্লীর বিভাজন তিনি সহ্য করতে পারেননি। সেখানে যোজনা করতে চেয়েছেন সাংস্কৃতিক-মানবিক বহুত্ববাদ ও নান্দনিক সম্মিলনের বাতাবরণ।  

রোগ শয্যায় থেকেও নিউইয়র্কের ভাড়া বাড়িতে রোপণ করেছিলেন জীবনের প্রতীক সবুজাভ উদ্ভিদ-পুষ্প ও লতা-গুল্মের ঝাড়। আক্ষরিক অর্থেই প্রাণপ্রবাহে টুইটুম্বুর ছিলেন তিনি।  

এমন একজন জীবনবাদী মানুষ হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে মৃত্যুর উপমায় মিলতে চায় না। মৃত্যুকে পরাজিত করে জীবনই জেগে থাকে তার চারপাশ ঘিরে। এমনকি ব্যক্তিক মৃত্যুকে অতিক্রমী তার কর্ম ও কীর্তির চিরঞ্জীব সত্ত্বা ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয় সকলের সামনে; বিশ্বভুবন জুড়ে।  

যে স্বীকৃতির প্রতিধ্বনি ঢাকা, কলকাতা, নিউইয়র্ক, টরোন্টো হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়াতে ছড়াতে এখন স্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নিয়েছে অখণ্ড বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সোনালি পাতায়।

ইতিহাস হুমায়ূন আহমেদকে যেভাবে বুকে টেনে নিয়েছে; হুমায়ূনও তেমনিভাবে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের শহীদ পিতার একদল মেধাবী সন্তানের একজন এই হুমায়ূন আহমেদ। দারিদ্র্য, রাজনৈতিক সঙ্কট, আর্থ-সামাজিক ঝড় পেরিয়ে হুমায়ূন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন, সেটা বিশ্বজয়ের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। বিজ্ঞানের কঠিন ভূমি থেকে তিনি মেরু-দূরত্বের জায়গা সাহিত্যের প্রায়-প্রতিটি ক্ষেত্রেই অঙ্কন করেছেন নিজের সাফল্য চিহ্ন।  

গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত ও গীত রচনা এবং অবশেষে চিত্রপ্রদশর্নীর মাধ্যমে তিনি জানিয়ে গেছেন তার বহুমাত্রিক দ্যুতিময় প্রতিভা ও কৃতিত্বের জগত সম্পর্কে।  

মা মেহের আফরোজ শাওনের কোলে হুমায়ূন পুত্র।  যোগ্যতা, শ্রম আর অধ্যাবসায়ের মেলবন্ধনে তিনি সকল বিঘ্নের প্রাচীরকে চূর্ণ করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন সাফল্যের শীর্ষতম বিন্দুতে। জনপ্রিয়তা আর হুমায়ূন আহমেদ পরিণত হয়েছিল এক ও অভিন্ন সত্তায়। ম্যাজিকের মতো তিনি করতলবদ্ধ করেছিলেন মানুষের ভালোবাসা ও পাঠকের সমর্থনের অসংখ্য নদী। জনপ্রিয়তাকে করেছিলেন মুষ্ঠিবদ্ধ।  

জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে উৎকৃষ্ট সৃষ্টিশীলতার সংমিশ্রণ হুমায়ূন আহমেদের প্রধানতম কৃতিত্ব। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের কথা বললে, উপন্যাসের কথা বললে, টিভি নাটকের কথা বললে, ব্যবসা সফল গ্রন্থ বা সিনেমা-নাটকের কথা বললে সবচেয়ে আগে আসে হুমায়ূন আহমেদের নাম।  

আরও পড়ুন: অনন্ত নক্ষত্র বীথির পথে 

হুমায়ূন সকলের জন্যে লিখেছেন; নাটক করেছেন। কাজের লোক থেকে পণ্ডিত পর্যন্ত সবাই তার পাঠসঙ্গী। মানবিক আবেগ ও সূক্ষ্ম অনুভূতির মানুষ মাত্রেই হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত-অনুরাগী। যুক্তি বা আধিভৌতিকÑউভয়বিদ জগতের মধ্যেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করেছেন মিসির আলী বা হিমু বা শুভ্রকে নিয়ে। বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে অপু, দুর্গা, নন্দিনী, অপলা কিংবা ফেলুদা, প্রোফেসর শঙ্কু বা কর্নেলের মতোই হুমায়ূনের চরিত্রগুলো স্থায়ী আসন পাবে।  

বাংলার আধুনিক সাহিত্যধারায় নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্কট ও অবদমন ফেটে বেরিয়েছে তার কলমে। তিনিই দূর মফস্বলের একটি অদ্ভ‍ূত ও বিচিত্র মানব বা মানবীর মনোজগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় ইংলিশ মিডিয়ামে অধ্যয়নরত বিচ্ছিন্ন-তরুণী পাঠিকাকে। আবার গ্লোবালাইজেশন তাড়িত বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের পরম্পরায় আবদ্ধ করেন তিনি।  

সাহিত্যের অমর প্রতিভা আবার তিনিই তার নাটকে বাংলার মরমী, আউল-বাউল, বিচ্ছেদের গানগুলোকে নবতর আবহে তুলে ধরেছেন; ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করেছেন। পূর্ব মৈমনসিংহের নেত্রকোনা তথা ভাটি বাংলার হাওরাঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, বৃহত্তর সিলেটের লোক সংগীতের অপরূপ জগতকে তিনি নতুনভাবে উন্মোচিত করেছেন।  

শ্বাশত বঙ্গের চিরায়ত ও লোকজ সংস্কৃতির আধুনিক ভাষ্যকারও হুমায়ূন আহমেদ। তার মতো করে সেসব কথা আর কেউ লিখে যেতে পারেননি; তুলে ধরতে সক্ষম হননি।

কর্মের অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যে হুমায়ূন আহমেদ নশ্বরতা থেকে অবিনশ্বতার দিকে যাত্রা করেছেন। রেখে গেছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা; প্রজন্মের পর প্রজন্মের পাঠক। ব্যক্তিক অস্তিত্ব অতিক্রমী হুমায়ূন বাংলা সাহিত্যের মহাকালিক মহাসড়কের অমর প্রতিভূ।

পরবর্তী কিস্তি: নায়কের বীরোচিত প্রত্যাবর্তন

লেখক: ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি, লেখক ও অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।  
[email protected]      

বাংলাদেশ সময়: ১২২৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৭
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।