ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৬)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৭
কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৬) কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা

[পূর্বপ্রকাশের পর]
মেসিডোনিয়া ১৯৯১ সালে সাবেক যুগোস্লাভিয়া থেকে বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই স্বাধীনতা লাভ করে। তারপরের এক দশকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কিন্তু ৯৯ সালের দিকে কসোভো যুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে শুরু করে। কসোভোর কয়েক লাখ শরণার্থী ঢুকে পড়ে মেসিডোনিয়াতে। মেসিডোনিয়ার মতো ক্ষুদ্র আয়তন ও ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশের পক্ষে সে চাপ সামাল দেওয়াটা ছিল বেশ কঠিন।

এই শরণার্থীরা মূলত আশ্রয় নেয় মেসিডোনিয়ার উত্তরাঞ্চলের আলবেনিয়ান প্রধান এলাকাগুলোতে। অনেকটা এই সময়ে মেসিডোনিয়ার ভেতরে কিছু আলবেনীয় সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় হয়ে ওঠে, তাদের দাবি ছিল আলবেনীয় ভাষাকেও মেসিডোনীয় ভাষার সমান মর্যাদা দেওয়া, সে ভাষায় আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, সরকারে অধিকতর আলবেনীয়দের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, আলবেনীয় পতাকা ওড়াবার স্বাধীনতা প্রদান, ইত্যাদি।

কিন্তু মেসিডোনিয়া সরকার এ দাবিগুলোর পেছনে কালো মেঘের বার্তা খুঁজে পেল। সেটি পাওয়া অবশ্য সেসময়ে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। কারণ, ঠিক সেসময়েই কসোভোতে চলছে ব্যাপকতর যুদ্ধ, যে যুদ্ধ কসোভোর আলবেনীয়রা করছে কসোভোকে যুগোস্লাভিয়া থেকে আলাদা করার জন্যে। আর তাই মেসিডোনিয়ার আলবেনীয়রা যে দু’দিন পর আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে আলবেনীয়-প্রধান এলাকাগুলোকে কসোভোর সঙ্গে কিংবা পশ্চিমের আলবেনিয়ার সঙ্গে জোড়ার দাবি করবে না তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?

কসোভোতাই শুরুতে তারা বেশ শক্ত অবস্থানে গেলো এই আলবেনীয় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। ওদিকে আলবেনীয় বিদ্রোহীরা তখন সামরিক ও অন্য সহযোগিতা পাচ্ছে কসোভোর বিদ্রোহীদের কাছ থেকে। এমনকি অভিযোগ আছে সে অঞ্চলে তখন মোতায়েন ন্যাটোর সৈন্যরা এ আলবেনীয় বিদ্রোহীদের সীমান্ত পার হয়ে মেসিডোনিয়ায় গিয়ে মেসিডোনিয়ান আলবেনীয়দের সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করার ব্যাপারটি জেনেও না জানার ভান করে, উল্টে মেসিডোনিয়ার সেনাবাহিনীকে পাল্টা অ্যাকশন নেওয়ার বেলায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করে।

আর এসব কারণেই সংঘাতের প্রথম দিকটাতে মেসিডোনিয়ার সরকারিবাহিনী বেশ মার খায় আলবেনীয় বিদ্রোহীদের কাছে। ও বছরের শেষ নাগাদ অবশেষে ন্যাটোর চাপ ও হস্তক্ষেপে অখ্রিদ শহরে মেসিডোনিয়ার সরকার এবং এই আলবেনীয় বিদ্রোহীদের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ চুক্তির কারণেই মেসিডোনিয়ার সরকার এখন আলবেনিয়ানদের আলবেনীয় পতাকা ওড়াবার ব্যাপারে কিছুটা চক্ষু মুদে থাকবার নীতি অবলম্বন করে, যাতে এ নিয়ে আর নতুন করে দাঙ্গা না বাঁধে।

কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালাতবে সাধারণ মেসিডোনীয়রা সেই শান্তি চুক্তির ব্যাপারটিকে ভালোভাবে নেয়নি। ন্যাটো যে একধরনের চাপ প্রয়োগ করে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করেছিলো, যার ফলে আলবেনীয়দের এসব আবদার তাদের মেনে নিতে হয়েছিলো, সেটি এখনও দগদগে ঘায়ের মতো তাদের হৃদয়ে আছে। আর তাই অধুনা এই দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো বিবাদ না থাকলেও যে কোনো মুহূর্তেই পুনরায় সংঘাত ছড়িয়ে পড়াটা আশ্চর্যজনক কোনো ব্যাপার হবে না।

যাকগে, ছিলেম তো কসোভোর বাসে, তাই সে গল্পেই ফিরে আসি না হয়। নির্ধারিত সময়ের এক চুলও এদিক-ওদিক না করে ঠিক সময়েই বাস ছেড়েছিল। আমার পাশের সারির সিটে এসে বসেছিলেন এক বৃদ্ধ, কেন যেন এক সকৌতূহলী দৃষ্টিতে তিনি মাঝে মধ্যেই আমার দিকে তাকাচ্ছেন। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছেন আমি ঠিক কোন দেশের চিড়িয়া। তার কৌতূহল মিটলো বাস যখন সীমান্তে এসে পৌঁছুলো, ইমিগ্রেশন পুলিশ পাসপোর্টে সিল মেরে আমার হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় বুড়ো নিজের থেকেই আমার পাসপোর্টটি চেয়ে নিয়ে সবুজ মলাটের উপর সোনালি অক্ষরে লেখা হরফগুলো পড়ে বিড়বিড় করে বললেন, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।

কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালাখুব বুঝতে পারলাম, এ দেশটির নামের সঙ্গে তিনি খুব ভালোভাবেই পরিচিত। সেটি অবশ্য হবারই কথা, কসোভো যুদ্ধের পরে বেশ কিছু বাংলাদেশি ত্রাণ কর্মকর্তা ও নিরাপত্তারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এদেশে এসেছিলেন। এরপর বুড়ো আমাকে সোৎসাহে সামনের শহরগুলোর নাম বলে যেতে লাগলেন, তিনি বলছেন আলবেনীয় ভাষাতেই, আমি কেবল বুঝে নিচ্ছি কী বলতে চাইছেন তিনি। যেন এক নতুন মুসাফিরকে নিজের দেশ দেখাচ্ছেন এভাবে তিনি কখনো আমাকে আঙুল তুলে দেখান রক্তিম বর্ণের পাথরের খনি আবার কখনো দূরের পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা খরস্রোতা নদী।

এর মাঝে আমার মোবাইলে একটি মেসেজ এসে আমাকে জানান দেয়, আমি নাকি এখন স্লোভেনিয়ায়। কিছুটা ঘাবড়ে যাই আমি, ব্যাপারখানা কী? ভূগোল যতটুকু জানি, তাই দিয়ে তো বলতে হয় স্লোভেনিয়া কসোভোর কোনো প্রতিবেশী দেশ নয়, বরং সেই সার্বিয়া-ক্রোয়েশিয়া পার হয়ে উত্তরের এক দেশ স্লোভেনিয়া, তাহলে হঠাৎ এমন মেসেজের মানে কী?

চলবে...

**কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৫)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-১)
**কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-২)
**কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৩)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৪)

 

বাংলাদেশ সময়: ০৪০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৭
এএ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।