ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

কবিতা

প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প | আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৬
প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প | আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য বিভাগের বিশেষ আয়োজন ‘প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প’র এবারের পর্বে থাকছে, কবি আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের নিজের লেখা প্রিয় পাঁচ কবিতা ও সেগুলো লেখার পেছনের গল্প।

কবি আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের জন্ম সিরাজগঞ্জে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে এখন শিক্ষকতা করছেন ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে।

প্রকাশিত গ্রন্থ, অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান (২০১৬)।

বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য বিভাগের বিশেষ আয়োজন ‘প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প’র এবারের পর্বে থাকছে, কবি আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের নিজের লেখা প্রিয় পাঁচ কবিতা ও সেগুলো লেখার পেছনের গল্প।  


প্রিয় পাঁচ কবিতা

সমুদ্রে সমুদ্র ডুবে যায়
একটা ফুলের গন্ধ কেন এমন বিশাল ভারী?
যুগ চলে যায়, যুগ চলে যায়...তবু, সেই একটা প্রথম রাতে
বারে বারে অন্ধকারে খুব পুরাতন জ্বলে ওঠা চাঁদ।

একটা ফুলের গন্ধ কেন অমন বিশাল ভারী?
অবুঝ জাতের সবুজ নিয়ে, চিল-ওড়া নীল আকাশ নিয়ে
এক টুকরো এই জায়গা কেন
দুনিয়া-জোড়া মায়ার চেয়ে, কালো-কাজল ছায়ার থেকেও গাঢ়?

যুগ চলে যায়, যুগ চলে যায়...একটুকু এই জায়গা জুড়ে
অযুত চোখের জল নিভে যায়, নিযুত চোখ ভাসে।
মরণকূলের নদীর তবু এপার ওপার আছে;
এইখানে চোখ ভাসালে, সমুদ্রে সমুদ্র ডুবে যায়।
ডুবে গেলে অনন্তকাল ভাসতে থাকে স্মৃতি-গন্ধা ফুল।

সেই একটা ফুলের গন্ধ কেন এমন বিশাল ভারী?

লাল রঙে বহুদিন রক্ত হয় না
ফুলের বনে বসে আছি বলে রক্তকে আমার শিউলিবোঁটার লাল মনে হয়।
নদীকে নদী, তালপাতাকে তালপাতা, শালিককে শালিক; কেবল
'যুদ্ধ' শুনলে মনে হয় যেন যুদ্ধ নয়, বহু বহু বহুকাল আগে
কেউ কেউ মরেছিল, কেউ কাউকে মেরেছিল।  

যেন লাল রঙে বহুদিন রক্ত হয় না।  
যেন ফুলেরা এসে সব রঙ শুষে নিয়ে ফুল হয়েছে।
রক্তজবা, গোলাপ, রঙ্গন, ডালিম, কৃষ্ণচূড়া...
রক্তের নদীতে নাও ভাসালে নয়তো ডুবে গেলে মনে হবে সমস্ত রক্ত অজস্র ফুল।

দারুণ মন্দ গন্ধগণ
একবারই কেবল বৃষ্টি ছিল, তুমি ছিলে, হাসনাহেনার গন্ধ ছিল।
বহুকালের দিনের পরে একবারই খুব সন্ধ্যা হল।

আমাদের হাজার ইতিহাসের এই একটা কেবল বলার মতোন।

একবারই পুরো জনমের ইতিহাসে শ্রাবণ শেষে ফাগুন এল।
একবারই সব ফুলের সাথে ঘোলা জলের দেখা হল।  
অন্ধকারে একবারই কেউ বিনা আগুন জ্বলেছিল।

শরীর পোড়া হলদে গন্ধ নিয়ে সেই প্রথম, সেই শেষ!
এরপর তুমি চলে গেলে, আমি ছায়ার সুরে
ফিরে এসে দেখি সমস্ত ঘ্রাণ ভুলে ফেলে গেছ ঘরে।  
আর যতক্ষণ শরীরে মিলেছে শরীর, ভেসে ভেসে 
সব ছবি ছাই হয়ে আছে।

জলে একবারই কেবল ফুল ছিল, তুমি ছিলে, হলদেরঙের গন্ধ ছিল।
বহুকালের দিনের পরে একবারই খুব সন্ধ্যা হল।

আমাদের হাজার ইতিহাসের এই একটা কেবল বলার মতোন।

অন্য গাঙের গান, সমুদ্র-সমান
এক একটা দীর্ঘ দারুণ শ্বাসে হাজার-শতেক শিউলি আবার ফোটে।
এক একটা ঘন মনের ঘ্রাণে মোরগজবা রঙিন হয়ে গাঢ়।
এক একবার উদাস হলে চোখ, সবুজ টিয়ায় ভূবন ছেয়ে যায়।

তবু নদী আমার, কোমল ইছামতি কেমন করে শুকায়ে যাও রোদ্দুর-বৈশাখে!
এইবার দিন গুণে গুণে জৈষ্ঠ্য আসার আগেই, নদী আমার, চলে যাবো মাইল-মাইল দূর।  
এই হলুদের ক্ষেত অযত্নে মিলায়ে যাবে; আমার খেজুরপাতার ছায়ায় বসবে জানিনা কোন জন, 
কোন পাখির হবে ঘর কে জানে জারুল-পাতার বুকের ভীষণ ভেতর।

বাহাত্তর বছর পর, নদী ইছামতি। এইবার আমার জুড়াবে দুই চোখ।
নতুন ভিটায় ফুটবে নতুন ভাত, জোছনা-বানে অন্য নতুন লোক…

অন্য গাঙের গান।
সমুদ্র-সমান।

যমুনা তো নদী নয়; কোনদিন সে ছিল না কোন নদী। যমুনা মায়া অথবা
যমুনা কেবল যুবকের হৃদয়, যুবতীর দেহ। যুবতীর অন্তর, যুবকের কায়া।
যমুনা কেবল প্রেম, উন্মাদ ঝড়ের ভাঙন, ঘোলা ঘোলা খোলা ঢেউ।

বাদলা দিনে যমুনার এক অসীম ওপারে...

জরা-পুরাতন বুকের গভীর থেকে মেঘের জলে খুঁজব তোমায় নদী।
শ্যাওলা-সবুজ হলে আমার ঘর, ইছামতি, এসো শ্রাবণ মাসে।
যদি সমস্ত আকাশ ভিজে থাকে, তারার আগুন যদি নিভে যায়।

রক্তহীন রক্তাক্ত এইসব চোখ
রক্তপাত ছাড়াও আরও হাজার উপায়ে মানুষ মরে যেতে পারে।
সহস্র অন্য রঙে দারুণ মৃত্যু হতে পারে প্রতিদিন, প্রতিরাতে ।

তবু অজস্র অফুরান রক্ত কেমন অসহায় ম'রে গ'লে পড়ে।
উজাড় উদাস দুনিয়া জুড়ে
পাতার চেয়ে, ফুলের চেয়ে অনেক বেশি রক্ত ঝরে।

যাকে কোনদিন ছুঁয়ে দেখি নাই, যার রক্তের গন্ধ জানি না
তার অপেক্ষাতেও ক্লান্ত ভীষণ রক্তাক্ত হতে পারে চোখ।

বড় বেশি মায়া দুনিয়া জুড়ে।
প্রেমের চেয়েও অনেক বেশি মন।
মনের চেয়েও অনেক বেশি প্রেম।

রক্তহীন রক্তাক্ত এইসব চোখে চোখে
সহস্র অন্য রঙে নিদারুণ মৃত্যু হতে পারে প্রতিদিন, প্রতি রাতে।


কবিতার গল্প
এক নারীর জন্ম, বিয়ে, জীবন সমস্তই কেটে গেলো এক ধীরস্রোতা, মৃতপ্রায়, স্তব্ধ নদীর ধারে। নিরীহ সেই নদীর অন্যপারের সবকিছুই দেখা যায় স্পষ্ট: ওপারের নারকেল গাছে বাবুইয়ের বাসা, ধানের-গমের-আখের ক্ষেত, জংলী ফুলের জংলী রঙ ইত্যাদি। সেই নদীর নিভে যাওয়া ধারে অকালে মরে যাওয়া প্রথম সন্তানের কবর, বেলিফুলের ঝাড় আর হলুদের গাছে ছাওয়া। এই সব ছেড়ে একদিন নিরুপায় চলে যেতে হলো দূরের গ্রামে। পরের দেশ, পরের ভিটায়। সেই গ্রাম ছুঁয়ে বয়ে গেছে মাতাল যমুনা। বিশাল উতলা ঢেউ। অন্যপার এতোদূরে যে কেবল জল ছাড়া সমুখে কিছুই দেখা যায় না। তার কাছে যমুনাকে মনে হয় সমুদ্র।

'যমুনা তো নদী নয়; কোনদিন সে ছিলনা কোন নদী। যমুনা মায়া অথবা
যমুনা কেবল যুবকের হৃদয়, যুবতীর দেহ। যুবতীর অন্তর, যুবকের কায়া।
যমুনা কেবল প্রেম, উন্মাদ ঝড়ের ভাঙন, ঘোলা ঘোলা খোলা ঢেউ। '

যমুনায় ভাঙন আছে, প্রেম আছে কিন্তু নদী নেই। তার কাছে নদী মানে আলতো বয়ে চলা ছোট জলের ধারা। যমুনার একেকটা ঢেউ এসে ঘোর বর্ষার দিনে তাকে অসহায় করে ফেলে রাখে।
গল্পটি একই সঙ্গে বাস্তব এবং কবিতা। আমার নানীর ব্যক্তিজীবনে, ইছামতি আর যমুনা, এই দুই নদী কীভাবে, কতোখানি এসেছে তাই নিয়ে বছর দু'য়েক আগে লিখেছিলাম 'অন্য গাঙের গান, সমুদ্র-সমান' কবিতাটি। পরবর্তীতে এই নামেই বের হয় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ।

'সমুদ্রে সমুদ্র ডুবে যায়' কবিতাটি লিখেছিলাম আমার শিক্ষকতা জীবনের একেবারে শুরুর মাসে। দুই হাজার চৌদ্দ সন, সেপ্টেম্বর মাস। কবিতাটি যখন প্রথম ফেসবুকে নোট আকারে প্রকাশ করি, শেষে একটা 'দ্রষ্টব্য' জুড়ে দেওয়া ছিলো: ‘উৎসর্গ: ভালোবাসার জাহাঙ্গীরনগর ছেড়ে আসতে এতোকাল যাদের বুক ভেঙেছে...' 

মনে আছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরছিলাম। আমার নিজের ক্যাম্পাস না। কিন্তু বেশ নিয়ম করে ঘুরতে যাওয়া হতো একটা সময়। তো এইরকম একদিন আমার সঙ্গে এক বন্ধুও আসছিল ঢাকায়। কিন্তু তার আসাটা ভিন্ন। তার যাত্রা ছিলো ঘর ছেড়ে দূরে যাওয়ার মতোন বিষাদ-বিদায়ের। সেই বন্ধুর ভয়ানক শূন্য চোখটা গেঁথে রইল মনে। ফিরে এসে লিখলাম-

'মরণকূলের নদীর তবু এপার ওপার আছে;
এইখানে চোখ ভাসালে, সমুদ্রে সমুদ্র ডুবে যায়।
ডুবে গেলে অনন্তকাল ভাসতে থাকে স্মৃতি-গন্ধা ফুল।
সেই একটা ফুলের গন্ধ কেন এমন বিশাল ভারী?'

আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক দৃশ্য হলো- রাস্তায় হঠাৎ চোখে পড়া শবযাত্রা। মৃত্যু নিয়ে আজীবন আমার অফুরান দুশ্চিন্তা হয়। কিন্তু মৃত্যু, রক্ত  চিরকালই মানুষের কাছে স্বাভাবিক ছিলো। কষ্টের কিন্তু গ্রহণযোগ্য। আমি কেন জানি নিতে পারি না। 'লাল রঙে বহুদিন রক্ত হয় না' যখন লিখি, তোরো সালের শেষ বা চৌদ্দ সালের শুরুতে, চারিদিকের মৃত্যু আর রক্তপাতগুলোকে বৃথা মনে হতো। মনে হতো যুদ্ধ নেই কিন্তু মৃত্যু আছে, মৃতদেহ আছে কিন্তু ব্যক্তি নেই, স্মৃতি নেই। ওই বোধ থেকে লেখা যে, লাল রঙ আর রক্তের রঙ রাই। লাল এখন কেবলই ফুলের রঙ।  

'রক্তহীন রক্তাক্ত এইসব চোখ' আর 'দারুণ মন্দ গন্ধগণ' আমার প্রেমজীবনের দুইটি তীব্র অনুভুতির প্রকাশ।  

'যাকে কোনদিন ছুঁয়ে দেখি নাই, যার রক্তের গন্ধ জানি না
তার অপেক্ষাতেও ক্লান্ত ভীষণ রক্তাক্ত হতে পারে চোখ। '

একজনের ভীষণ অপেক্ষায় ছিলাম। দেখা হবে করে করে মাস পার হয়ে যাচ্ছিল। তার ছবি দেখি, বহু বহু দূর থেকে কথা বলি। কিন্তু কোনোভাবেই অপেক্ষা শান্ত হয় না। যে সন্ধ্যায় শেষমেশ দেখা হলো, তার ঠিক আগের রাতের কবিতা।  

আর 'দারুণ মন্দ গন্ধগণ' লিখেছিলাম সেই অতি ক্ষণস্থায়ী প্রেমের সমাপ্ত হওয়ার পরের রাতে। বারবারই মনে হচ্ছিল গন্ধেরও রঙ আছে। অতি তীব্র আর মায়াময়। সেই রাতে মনে হলো, সেই প্রিয় মানুষটার স্মৃতি একটা হলদে রঙের গন্ধ যেনো হাসনাহেনা, প্রজাপতি (তাও আবার বৃষ্টিস্নাত!); আমার চারপাশ, সারা ঘর ছেয়ে আছে। সেই অদ্ভুত অন্য রকমের সন্ধ্যা বোধহয় মানুষের জীবনে একবারই আসে, কেবল একবারই আসতে পারে।  

'একবারই কেবল বৃষ্টি ছিল, তুমি ছিলে, হাসনাহেনার গন্ধ ছিল।
বহুকালের দিনের পরে একবারই খুব সন্ধ্যা হল।
আমাদের হাজার ইতিহাসের এই একটা কেবল বলার মতোন। '

সেই একমাত্র সুগন্ধী সন্ধ্যার তারিখ ছিল দুই, মার্চ মাস, দুই হাজার পনের সন।  

বাংলাদেশ সময়: ১২০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৬
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।