ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

অ্যাডোনিসের কবিতা

ভূমিকা ও অনুবাদ : বিদ্যুত খোশনবীশ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২০ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১১
ভূমিকা ও অনুবাদ : বিদ্যুত খোশনবীশ

আধুনিক আরবি সাহিত্যের সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব সিরিয়ান কবি, প্রাবন্ধিক ও সামালোচক আলী আহমেদ সাঈদ। সারা বিশ্বে তার পরিচিতি অ্যাডোনিস নামে।

কবি স্বীকৃতি লাভের আশায় কৈশরেই তিনি গ্রহণ করেছিলেন গ্রিক পুনর্জন্মের দেবতা ‘অ্যাডোনিস’ এর নাম। জন্ম সিরিয়ার লাধকিয়া অঞ্চলের কাসাবিন নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে ১৯৩০ সালে। জীবনের নানা চরাই-উৎরাই পারি দিয়ে গত কয়েক দশক ধরে থিতু হয়েছেন ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি প্যারিসে।

অ্যাডোনিসের বয়স যখন বারো অর্থাৎ ১৯৪২ সাল পর্যন্তও তিনি কোন শহর, রেডিও এমনকি গাড়িও দেখেননি। এ সময় পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে। নিজ গ্রাম সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘তখনো এ গ্রাম সভ্যতার আতুর ঘরে। ’ তবে শৈশব থেকেই আরব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী আরবি কবিতার সাথে তার পরিচয় ঘটে বাবার মাধ্যমে। প্রতিভাবান এই কবি শৈশবেই নিজের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত করে নেন সদ্য স্বাধীন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকরি আল কোয়াতলিকে স্বরচিত কবিতা শুনিয়ে। প্রেসিডেন্ট সুকরি’র সহযোগিতায় তিনি ভর্তি হন লাধকিয়া অঞ্চলের একটি ফরাসি স্কুলে। তারপর দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সুফি তত্ত্বের উপর গবেষণার জন্য তিনি অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি।

গত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধিনতা তখনও ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রাচীন অহমিকা, জড়তা আর রাজনৈতিক সংকীর্ণতা তখনও আরব জাতিগুলোর স্বযত্ন-লালিত প্রথা। এই অচলায়তন শুধু যে রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, সংক্রমিত হয়েছিল আরবি সাহিত্যেও। বহু পশ্চাতে আরবি কাব্য ভূবনে নক্ষত্রতুল্য কবি-ব্যক্তিত্ব থাকলেও দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আরবি সাহিত্যে উন্মোচিত হয়নি নতুন কোন দিগন্ত কিংবা কারো পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি পূর্বপুরুষের গড়ে তোলা সীমানা প্রাচীর। আর এই ব্যর্থতার যন্ত্রণা থেকে যে কয়েকজন কবি অবতীর্ণ হয়েছিলেন আধুনিকতা অর্জনের লড়াইয়ে কবি অ্যাডোনিস তাঁদের অন্যতম। মেধা ও সাহসিকতার যুগপৎ বিহারে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহ, প্রত্যাখ্যান ও আধুনিকতার প্রতীক। লেবানিজ কবি ইউসিফ আল-খাল এর সহযোগে তিনি প্রকাশ করেন ‘শের’ নামক একটি সাহিত্য সাময়িকী যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল আরবি কবিতাকে সনাতন ছন্দের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে গদ্য কবিতার ধারা সৃষ্টি করা কিংবা তাঁর ভাষায় ‘গদ্যকে কবিতার স্তরে উন্নিত করা। ’ তাদের এই প্রচেষ্টায় যেমন শরীক হয়েছিলেন বহু মেধাবী মুখ তেমনি বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সংকীর্ণ মানসিকতার রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তাদের কর্মী-সমর্থক এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিরাও। তাঁদেরকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল কুচক্রী, আরব চেতনা বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে। ফলশ্রুতিতে ‘শের’ এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর তা নিষিদ্ধ হয়ে যায় সবকটি আরব রাষ্ট্রে।     

দামেস্কে থাকাকালিন অ্যাডোনিস যোগ দেন আন্তুন সা’দার সিরিয়ান ন্যাশনাল পার্টিতে। কিন্তু ১৯৪৯ সালে অভ্যুত্থানের অভিযোগে সা’দাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর দীর্ঘ সময় অ্যাডোনিসকেও কাটাতে হয় জেলখানায়। তবে কারামুক্তির পর ১৯৫৬ সালে তিনি চলে যান বৈরুতে। সেখানেই শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়। পরিচিত হন অনেক খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পীদের সাথে।

আরবি সাহিত্যের টি এস এলিয়ট খ্যাত পরাবাস্তব কবি অ্যাডোনিসের কাব্যচিন্তায় বিখ্যাত আরব কবি আল নিফ্ফারি ও আবু নুয়াস এবং ফরাসি কবি র‌্যাঁবো ও মালার্মে’র প্রভাব সর্বাধিক। র‌্যাঁবো তাঁর চোখে ‘প্রাচ্যের সুফি’। কারণ তাঁর বাবা কোরান অনুবাদ করেছিলেন এবং তিনি নিজেও আরবি অধ্যয়ন করতেন।

অ্যাডোনিস স্যুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদকে তুলনা করেছেন ঈশ্বরবিহীন মরমিবাদের সাথে। তিনি বিশ্বাস করেন, কোন বিষয়কে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার ক্ষমতা কোন শব্দেরই নেই। তাঁর মতে, শব্দ তাঁর অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ কোনটিকেই প্রতিফলিত করতে সক্ষম নয়। তাঁর অধিকাংশ কবিতাতেই এ বিশ্বাসের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। অ্যাডোনিস তাঁর ‘সংলাপ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘ঈশ্বর কিংবা শয়তান- আমি কাউকেই বেছে নেইনি/ প্রত্যেকেই দেয়াল/ প্রত্যেকেই আমার চোখ ঢেকে দেয়। ’ চিন্তার প্রথাগত বিন্যাসকে ভেঙ্গে দিয়ে তিনি এমন সব পরাবাস্তব কবিতা রচনা করেছেন যা শুধুমাত্র আরবি কাব্য ধারাকেই নয় প্রভাবিত করেছে পাশ্চাত্যের পরাবাস্তববাদকেও। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দামেস্কের মিহিয়ার’ কাব্যগ্রন্থকে গণ্য করা হয় পরাবাস্তববাদের আদর্শ অভিধান হিসেবে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি ঈশ্বর ও শয়তানের ঊর্ধ্বে আরোহণ করেছি/ আমার পরে কোন স্বর্গ নেই, কোন পতন নেই। ’ তাঁর কবিতা অতিমাত্রায় বিমূর্ত- এমন সমালোচনার জবাবে তিনি লিখেছেন, ‘এই অস্পষ্টতার মত অন্য কিছু আমাকে স্পষ্ট করে না/ কিংবা এই স্পষ্টতার মত অন্য কিছু আমাকে অস্পষ্ট করে না। ’

নির্বাসনই আরব কবিদের নিয়তি। এ কথা বললে হয়তো ভুল হবে না যে, আধুনিক আরবি কবিতার বিকাশ ঘটেছে নির্বাসনে। অ্যাডোনিসের মতে শুধু আরব কবিরাই নন, আরবি ভাষাও জন্ম নিয়েছে নির্বাসনে। এক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘আমি যে ভাষায় লিখি সে ভাষাই আমাকে নির্বাসিত করে। ’ আরব সংস্কৃতি ও সাহিত্যের স্থবিরতা নিয়ে মন্তব্য করে তিনি বিতর্কীত হয়েছেন বহুবার। তিনি মনে করেন, পাশ্চাত্যের প্রভাব উবে গেলে মসজিদ, গির্জা আর ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া আরবদের আর কিছুই অবিশিষ্ট থাকবে না। এক সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘এক অর্থে আমরা আরবরা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। কারণ বিশ্ব সভ্যতায় আমাদের কোন বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্থিতি নেই। ’ তার ‘আগুনের বৃক্ষ’ কবিতায় এই চিন্তারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়-‘আমার জনগণ/ মৃত্যুবরণ করেছে আগুনের মত/ তারা মৃত্যুবরণ করেছে কোন নিশানা না রেখেই। ’

অ্যাডোনিস ২০০৫ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য শর্ট লিস্টেড হয়েছিলেন, যদিও এ পুরস্কার তিনি পাননি। তবে এযাবৎ ভূষিত হয়েছেন বহু মূল্যবান পুরস্কারে। দামেস্কের মিহিয়ার (১৯৬১), ছাই ও গোলাপের মধ্যবর্তী সময় (২০০৪), কেবল যদি সমুদ্র ঘুমাতে পারতো (২০০৩), দিবা-রাত্রির পাতা (২০০১), অ্যাডোনিসের রক্ত (১৯৭১), মানচিত্রের শিকার (১৯৮৪)  তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।

প্লাবন

যাও, কবুতর, যাও।
প্রত্যাশিত নয় তোমার প্রত্যাবর্তন।
ওরা ওদের মাংসকে পাথরের কাছে সমর্পণ করেছে।
আর আমি-- এইতো আমি
পিছলে যাচ্ছি গভীরতম প্রান্তে,
জড়িয়ে আছি কিস্তির পালে।
এই প্লাবনই আমাদের গ্রহ,
যার কোন আবর্তন নেই--
বিনাশী আর সুপ্রাচীন।
এখানেই হয়তো পাওয়া যাবে
সমাহিত শতাব্দীর ঈশ্বরের ঘ্রাণ।
তাই তো বলছি- যাও, কবুতর, যাও।
প্রত্যাশিত নয় তোমার প্রত্যাবর্তন।

ক্ষুদ্র সময়

ইন্দ্রজালিক মরিচিকা এবং
দৃষ্টিহীন দিনগুলো-- আমাদের।
আর পথপ্রদর্শকের মৃতদেহ-- সেটাও আমাদের।
আমরা-- সেই কিস্তির প্রজন্ম,
এই ক্ষুদ্র সময়ের সন্তান-সন্ততি।
প্রশান্ত সমুদ্র-- যে সমুদ্র স্তব করে
অভিযাত্রার শোকগাথা;
যে সমুদ্র আমাদের অর্পণ করেছে তেপান্তরের কাছে।
এই আমরা-- আমাদের ধ্বংসস্তুপ এবং
স্রষ্টার মধ্যে অন্তহীন সংলাপের প্রজন্ম।

আমি তোমাকে বলেছিলাম
আমি তোমাকে বলেছিলাম:
আমার উদ্দেশে সমুদ্রের উচ্চারিত পংক্তিগুলো
আমি শুনি।
আমি শুনি সেই ঘণ্টাধ্বনি,
ঝিনুকের খোলসে যে শায়িত সুখনিদ্রায়।
আমি তোমাকে বলেছিলাম :
শয়তানের বিবাহ উৎসব আর
উপকথার ভোজসভায় আমি সংগীত পরিবেশন করি।
আমি তোমাকে বলেছিলাম:
ইতিহাসের বৃষ্টি আর দূরের রক্তিমাভায়
আমি দেখি-- এক পরী আর এক বসতবাটি। কারণ,
আমার দৃষ্টির ভেতরেই আমি তরী ভাসাই।
আমি তোমাকে বলেছিলাম : আমি সব-ই দেখি;
আমি সব-ই দেখি দূর-যাত্রার প্রথম পদক্ষেপেই।

জগতের সমাপ্তি

সম্ভাবনা আমাকে ভাবায় না,
হোক তা বেদনাদায়ক কিংবা আনন্দদায়ক।
কারণ, স্তব করতে করতে
আমি আবিষ্কার করেছি আমার নিজের কিতাব।
আর আমি সেই জগতের জন্য আশ্রয় খুঁজি,
যে জগতের আরম্ভ এই জগতের সীমান্তে।

প্রাচীন স্বদেশ

আমার নিশানগুলোর টুটি চেপে ধরে
আমি ওদের সমর্পণ করেছিলাম পাথর আর প্রতিধ্বনির কাছে।
আমি ওদের সমর্পণ করেছিলাম ধুলার দুর্গ
আর পরাজয় ও প্রত্যাখ্যানের মর্যাদার কাছে।
তুমি ছাড়া আমার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই--
হে রহস্য!
হে প্রাচীন স্বদেশ!

অনন্তের দেশে

যদি-বা তুমি ফিরে আসো, হে অডিসিয়াস!
এমনকি যদি হ্রস্ব হয়ে যায় প্রতিবেশ,
কিংবা যদি ভস্মিভূত হয় পথপ্রদর্শক
তোমার শোকাচ্ছন্ন চেহারার প্রাখর্যে
কিংবা সহৃদয় ত্রাসে,
তবুও তুমি রয়ে যাবে অভিযাত্রার ইতিহাসে,
তবুও তুমি রয়ে যাবে প্রতিশ্রুতিহীন দেশে,
তবুও তুমি রয়ে যাবে অনন্তের দেশে।
যদি-বা তুমি ফিরেও আসো,
হে অডিসিয়াস!

বাংলাদেশ সময় ১৫৪৫, মার্চ ২৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।