ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আমাদের চেতনার বইমেলা

সৈকত হাবিব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১১
আমাদের চেতনার বইমেলা

প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলে বাঙালির মধ্যে প্রধানত যে চেতনাবোধটি সক্রিয় হয়ে ওঠে তা হলো তার ভাষাচেতনা। কারণ আমাদের জানা ইতিহাস অনুসারে পৃথিবীতে বাঙালিকেই প্রথম নিজের মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তদান করতে হয়েছে।

বাঙালির কপালটাই এমন, খুব ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত পাওনার জন্যও তাকে নিজেকে ক্রমাগত বলি দিতে হয়, তাও কপালে তার প্রাপ্তি জোটে অল্পই।

বাঙালির একটা আশ্চর্য গুণ আছে, সে হলো তার স্বপ্ন দেখার অনিঃশেষ ক্ষমতা। বাস্তবতা যতই বৈরী হোক, জীবন যতই হোক শৃঙ্খলিত-পরাজিত-বিপর্যস্ত, আশার শক্তি তার তারচেও বহুগুণে বেশি। তাই সে দুর্ভিক্ষেও শেষ হয়ে যায় না, মন্বন্তরেও টিকে থাকে; শোষণ-শাসন-অপশাসন, দুর্নীতি-নৈরাজ্য-লুণ্ঠন, খরা-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস কিছুই তার অনিঃশেষ আশাকে পরাভূত করতে পারে না। কিন্তু তার দোষটাও খুব সামান্য নয়, সে যত সহজে মৃত্যুকে গ্রহণ করতে পারে, জীবনকেও বোধহয় ততটা পারে না। তাই শত শতাব্দী ধরে তার আত্মদানের ইতিহাস যতটা গৌরবময়, আত্মগঠনের ইতিহাস ততটাই অগৌরবের।

তার অর্জনের ইতিহাস যা, হারানোর ইতিহাসও তাই। কারণ, সে অর্জনকে সে খুব কমই ধরে রাখতে পেরেছে। যেটুকু পারে তাও বেহাত হয়ে যায় তার স্বজাতিরই একটি শ্রেণীর হাতে, তাই সর্বজনীন প্রাপ্তি তার সামান্যই। কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা তবু সর্বজনের জন্যই।

এই সর্বজনীনতা যেমন একুশের মূল চেতনা, তেমনি একে ঘিরে বাংলা একাডেমীতে মাসব্যাপী একুশের বইমেলারও মূলসুরটি তাই। তাই ফেব্রুয়ারি যেমন বাঙালির একুশের মাস, তেমনি তার বইমেলারও মাস। একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, এই বইমেলা কোনো প্রতিষ্ঠানের তৈরি নয়, বরং বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির সর্বজনীনতাবোধের গণ-আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ। যদিও এটি শুরু হয়েছিল অনেকটা ব্যক্তি-উদ্যোগে, বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনার অন্যতম পথিকৃৎ চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমী চত্বরের মাটিতে চটের ওপর বই বিছিয়ে বইমেলার চারাটি রোপণ করেছিলেন। কিন্তু জনমানসের স্বতস্ফূর্ত সাড়া পেয়ে গত তিন যুগের বেশিকাল ধরে এটি এক বিরাট বৃক্ষে পরিণত হয়ে এখন একুশে-চেতনার একটি মহত্তম প্রকাশ-মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

তবে বইমেলা যতই বিস্তৃত হোক, একুশের চেতনার কতটা বিস্তার ঘটেছে সে নিয়ে বোধহয় তর্ক তোলা যেতেই পারে। এটা ঠিক যে, একুশের বইমেলাকে ঘিরে বাংলাদেশে লেখক-পাঠক-প্রকাশকের অন্তরঙ্গ সম্মিলন ঘটে, এবং একে ঘিরেই আমাদের সৃজনশীল প্রকাশনার বিস্তর। কিন্তু পরিমাণের যে উৎকর্ষ, সে তুলনায় গুণ বা মানের উৎকর্ষ কতটা, তা বড় বিচার্য বিষয়। প্রযুক্তির কল্যাণে বহু বইয়ের বহিরঙ্গ ঝলমলে হলেও, ভেতরের যে সারবস্তু, অর্থাৎ ভাষা-বানান-বাক্য, তার উৎকর্ষ কিন্তু আজও অনেক দূরের বিষয়। কারণ খুব কম প্রকাশনাই স্রেফ লাভালাভের ঊর্ধ্বে একটি দায়িত্বশীল কাজ হিসেবে মনেপ্রাণে একে গ্রহণ করতে পেরেছে। প্রকাশনা যে একটি ব্যবসামাত্র নয়, এ বোধটি কাজ করে না বলেই, অনেক প্রকাশনা সংস্থাতেই একজন ভালো প্রুফরিডারই নেই, পান্ডুলিপি পরীক্ষক বা প্রকাশনা সম্পাদক তো দূরের কথা। তাদের অনেকেই বানান সংশোধনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়াকে অপচয় বলেই মনে করেন। তবে খুব ধীরে ধীরেও যে এই অবস্থায় পরিবর্তন আসছে এটা আশার কথা। কিন্তু বইমেলাকে ঘিরে তবু বইয়ের এই যে জাগরণ একেও আমাদের বড় অর্জনই বলা যেতে পারে।
      
এ প্রসঙ্গে কথা আসে একুশের চেতনার প্রধান প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীকে নিয়েও। বাংলা একাডেমী এবং একুশের বইমেলা এখন অঙ্গাঙ্গী জিনিস। কারণ, একাডেমীই এই মেলার কর্ণধার। কিন্তু তারা এখনো অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। প্রতি বছরই স্টল বরাদ্দে দুর্নীতি, পক্ষপাত, দলীয়করণ, অব্যস্থাপনা ও অনিয়মের অভিযোগে তারা অভিযুক্ত হন। নানা পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে অনেক সময় গণমানুষের স্বতস্ফূর্ততা বাধাগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারটিও রয়েছে।

তবে তাদের কিছু ভালো উদ্যোগও আছে। বইমেলাকে বারোয়ারি মেলা থেকে উদ্ধার করে কেবল বইয়ের মেলা করা তার মধ্যে একটি। আরেকটি হলো প্রবেশপথ বাড়িয়ে জনদুর্ভোগ কমানো। কম  প্রবেশপথ ও নিরাপত্তাজনিত কারণে গত আগে যে দুর্ভোগ মানুষকে পোহাতে হচ্ছিল, তা থেকে মানুষ রেহাই না পেলেও, কমেছে (ছুটির দিনগুলো বাদে)।
অন্য আরেকটা কাজ হলো, ছোটকাগজের জন্য স্টল বরাদ্দ করা, যদিও তা পর্যাপ্ত নয়।
বাংলা একাডেমী এ বছরই আরেকটি ভালো কাজ করল। অনেক দিনের দাবি ছিল বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে রাষ্ট্রপ্রধান/সরকারপ্রধান-কেন্দ্রিক না করে বিশ্ববিখ্যাত লেখক-বুদ্ধিজীবীদের অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো। এ বছর অমর্ত্য সেনকে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে বাংলা একাডেমী একটি ধন্যবাদযোগ্য দায়িত্ব পালন করল। অন্যদিকে এ বছর রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীকে সামনে রেখেও একাডেমী বইমেলায় বেশ কজন আন্তর্জাতিক রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, এটি একটি সুখবর।       

কিন্তু এখনো আরো কিছু কাজ করার বাকি আছে। যেমন : প্রতি বছরই নতুন প্রকাশকদের স্টল পেতে কাঠখড় পোড়াতে হয়, অথচ বছরে বছরেই অনেক সম্ভাবনাময় সৃজনশীল প্রকাশনা মাঠে নামছে। তাদের প্রতি একাডেমীর আরো সদয় হওয়া প্রয়োজন।   কারণ, তাদের বিপণন ও প্রচারের জন্য বইমেলার চেয়ে কার্যকর কোনো মাধ্যম নেই। দ্বিতীয়ত, প্রতি বছরই দেখা যায়, মেলা চত্বরে অনেক এনজিও ও সংস্থা-সংগঠনের জন্য বেশ কিছু স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। আমরা জানি, প্রায় সব এনজিওরই নির্দিষ্ট পাঠকগোষ্ঠী বা নেটওয়ার্ক আছে, তাদের প্রকাশনাও সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য। এদের সবাইকে পৃথক পৃথক স্টল বরাদ্দ না দিয়ে যদি কয়েকটা স্টলের সমান জায়গা বরাদ্দ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গা দেওয়া হয়, তাতে তাদের জন্যও ভালো হয়, আগ্রহীরাও তা অনায়াসে পেতে পারেন। অন্যদিকে গত দু বছর ধরে দেখা যাচ্ছে মিডিয়ার জন্য বেশ কিছু স্টল বরাদ্দ করা হয়। এটা না করে যদি তাদের সবার জন্য একটি বিশেষ জায়গা দেওয়া হয়, তাতেও অনেকটা জায়গা সাশ্রয় হয়। এসব জায়গা নবীন প্রকাশনাগুলোকে বরাদ্দ দিলে তারাও অনেক উৎসাহিত হয়। অন্যদিকে প্রকাশনা সংক্রান্ত পুরস্কারের তরুণ প্রকাশকদের জন্যও প্রণোদনামূলক পুরস্কার থাকা দরকার, এতে তারা আরো যত্নবান ও পেশাদার হবেন।  

সব প্রকাশকই যেমন কমবেশি শিশু-কিশোর সাহিত্য প্রকাশ করে, আবার কেবল শিশু-কিশোর প্রকাশনাও আছে কয়েকটি। এইসব বই এবং প্রকাশনাগুলো মিলিয়ে যদি বইমেলায় একটি শিশুসাহিত্য চত্বর থাকতো, তাহলে বইপ্রেমিক শিশু-কিশোররা অনেক ভিড় ঠেলাঠেলি থেকে রক্ষা পেয়ে পছন্দের বই সানন্দে সংগ্রহ করতে পারত।

আমরা আশা করতেই পারি, আগামী মেলায় একাডেমীর কর্তারা বিষয়গুলো আন্তরিকভাবে বিবেচনা করবেন। কারণ, তারাও এটা ভালো করেই জানেন, এই মেলাটিকে যত বেশি সহজগম্য করে তোলা যাবে, একুশের উদ্দেশ্য ততই সার্থক হবে।

একুশ যেমন আমাদের অস্তিত্বের অংশ, একুশে বইমেলাও তাই। একে আমরা যত সুষ্ঠু ও সুন্দর করে তুলতে পারব, আমাদের অস্তিত্বেরও ততটাই উৎকর্ষ সাধিত হবে।     

[email protected]

বাংলাদেশ সময় ১৮৪৫, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।