ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

মফস্বলে সাহিত্যচর্চা এবং একজন রাজিত রহমান

সিয়াম সারোয়ার জামিল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৬ ঘণ্টা, জুন ৭, ২০১২
মফস্বলে সাহিত্যচর্চা এবং একজন রাজিত রহমান

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য সম্ভাবনাময় প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিক রয়েছেন, যারা রাজধানী কেন্দ্রীক আধুনিক সাহিত্যচর্চায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। ফলে সেভাবে তাদের জাতীয় পরিচিতি গড়ে তোলার সুযোগও থাকে না।

মফস্বল সাহিত্যের এসব কারিগরদের জাতীয় পরিচিতি নেই ঠিকই কিন্তু স্থানীয় পর্যায়েই গড়েছেন নিজস্ব সাহিত্য সম্পদ, সমৃদ্ধ করে চলেছেন মফস্বলের সাহিত্য ভাণ্ডারকে।

রাজধানীকেন্দ্রীক সাহিত্যিকদের আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া মফস্বলের অখ্যাত অথচ প্রতিভাবান কথাশিল্পীদেরই একজন হলেন ক্ষণজন্মা কবি রাজিত রহমান। যিনি যথেষ্ট প্রতিভাবান হবার পরেও শুধুমাত্র মফস্বলের লেখক হওয়ার কারণে সকলের অগোচরেই থেকে গিয়েছিলেন, আজীবন অবমূল্যায়িত হয়েছেন।

মফস্বলের লেখক হওয়ার পরও রাজিত রহমানের লেখার মাঝে যে শিল্পবোধ রয়েছে তা হয়তো প্রতিষ্ঠিত লেখকদের চেয়ে অতটা উচ্চমানের নয়, তবু স্থানীয় পর্যায়ে তিনি যে ভিন্নধারার সূচনা করেছেন তা লক্ষণীয়। তার লেখায় জাতীয় বিষয়ের পাশাপাশি স্থানীয় সামাজিক সংকটগুলো উঠে আসে স্পষ্টভাবে।  

জন্ম: ১১ই আগস্ট ১৯৯২, মৃত্যু: ১৭ ই জানুয়ারী ২০১২। দেশের সর্বপশ্চিমের ছোট জেলা শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই তরুণ লেখকের সাহিত্যে মার্কসবাদী ভাবধারার আভাস পাওয়া যায়। যদিও তিনি কখনও নিজেকে রাজনীতিতে জড়াননি। তবে তার কবিতায় আধুনিক মানবতাবোধের স্পষ্টতা লক্ষণীয়।

রাজিত রহমান ছিলেন একাধারে কথা সাহিত্যিক, অনুবাদক, নাট্যকর্মী, সাহিত্য সংগঠক এবং ব্লগার। তিনি প্রতিনিয়ত পদে পদে অবমূল্যায়িত হয়েছেন, তবু কখনও দমে যাননি। সমাজের অসঙ্গতিগুলো তার রচনার ভাঁজে ভাঁজে ফুটিয়ে তুলেছেন নিরলসভাবে; লিখে গেছেন অবিরতভাবে দেশ-মা-মাটিকে বুকে ধারণ করে।

রাজিত রহমান মূলত কবিতা লিখতেন, তার লেখায় যে শক্তিমত্তা, সাবলীলতা, আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠার ছাপ পাওয়া যায় তার তুলনা সমসাময়িক তরুণদের মাঝে মেলা ভার। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কুড়ি বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে লিখেছেন শতাধিক কবিতা, গল্প, নাটিকা। এছাড়া বেশ কিছু গানও লিখেছেন তিনি। যা স্থানীয় পর্যায়ের গুণী মহলে সমাদৃত হয়েছে।

রাজিত সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন স্কুল জীবনে। নবম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় স্কুল সাময়িকী `অনির্বান` এ তার লেখা প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাননি। জেলা শহরের সাহিত্য জগতে একজন ভিন্নধারার তরুণ কবি হিসেবে দ্রুত নিজ চেষ্টায় স্থান করে নিয়েছিলেন।

রাজিত রহমান বাস্তববাদী ছিলেন। তার লেখায় জীবনবোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রগতিবাদের পাশাপাশি চলমান জীবনের অস্থিতশীলতা প্রকাশ হয়ে পড়ে প্রবলভাবে। তিনি "দৃশ্যপট-১" কবিতায় লিখেছেন

"অস্থির সময় কাটছে
আমার হৃদপিণ্ডের স্পন্দন,
আর তোমার ভেলকিবাজির উপঢৌকন;
কি করি, কোথায় রাখি
অসীমেও জায়গা কমে যায়!

লক্ষ্যহীন জীবনে লক্ষ্য নির্ধারণের তাগাদা
অথচ গন্তব্যগুলো ক্রমশই হচ্ছে অচেনা!

তোমার রেখে যাওয়া কাপে ঠোঁটের ছোয়া,
আর বাতাসে জানলার পর্দা উড়ে যাওয়া,
সব মিলিয়ে যাচ্ছে। "

কিশোর বয়সে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে বিদ্যুৎ নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। অন্যান্য কবিদের মত তিনিও প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। তার `কানসাট` কবিতায় তিনি লিখেছিলেন,

"আমি আর মানুষ হবো না
পিশাচ হয়ে যাব
হলি খেলবো না,
রক্ত নিয়ে খেলবো।

কানসাটের রাজপথ
তাজা রক্তে রাঙাবো
বুলেটের আঘাতে আঘাতে
জনতাকে স্তব্ধ করে দেব। "

২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ছাত্র নির্যাতনের ঘটনার পরপরই তিনি `হানাদার` কবিতাটি লিখেছিলেন-

"আট আনা-আট আনা
পাকি হায়েনা-বাঙালি হায়েনা
তফাৎহীন একই কথা
একই আয়না"

লেখালেখি করে তিনি যেমন আলো ছড়িয়েছেন, তেমনি সাহিত্য সংগঠক হিসেবেও পরিচিতি গড়েছিলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের একজন একনিষ্ঠ সংগঠক ছিলেন রাজিত। এছাড়াও উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, খেলাঘর আসর, প্রজন্ম পর-`৭১, প্রজন্ম জোট, মুক্ত মহাদল সহ স্থানীয় বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে ছিল তার আত্নার সম্পর্ক।

অকাল প্রয়াত রাজিত রহমান ছিলেন মূলত কবি, অস্থিমজ্জায় কবি। কবিতার প্রতি ভালবাসা থেকেই বন্ধু কবিদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ কবিতা পরিষদ। যা ভিন্ন ধারার সংগঠন হিসেবে ইতিমধ্যেই জেলা শহরে পরিচিতি গড়ে নিয়েছে।

রাজিত রহমান লিভারের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী অবস্থায় থাকার পর মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই তিনি পরলোকগমন করেন।

রাজিত হয়তো কোনো নক্ষত্র ছিলেন না। প্রকৃতি তাকে নক্ষত্র হওয়ার সুযোগ দেয়নি। তবে তিনি তার স্বল্প সময়ের জীবনে সকলের অগোচরে থেকেই মফস্বলের ভাষা-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে অবদান রেখেছেন। তার মত অসংখ্য প্রতিভাবান মানুষই অকালে হারিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যতটুকু রেখে যাচ্ছেন, তারই ইতিবাচক মূল্যায়ন প্রয়োজন। অবমূল্যায়িত হলে তা হবে ভাষা-সাহিত্যেরই ক্ষতি।

সিয়াম সারোয়ার জামিল, কবি ও ব্লগার
ইমেইল:[email protected]

শুক্রাবাদ, ধানমন্ডি, ঢাকা।
ফোন:০১৭১৯৯৯৩৮০৪, ০১১৯৩০৮৭১৭৫।

বাংলাদেশ সময় : ১৩১২ ঘণ্টা, ০৭ জুন, ২০১২
সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।