ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

হারিয়ে যাচ্ছে সিলেটের নাগরী ভাষা!

সাব্বির আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৩
হারিয়ে যাচ্ছে সিলেটের নাগরী ভাষা!

সিলেট: সিলেটের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নিজস্ব স্বকীয়তার এক বড় উদাহরণ নাগরী ভাষা। বর্তমানে ভাষাটি অপ্রচলিত, নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা।

তবে এটি পৃথিবীর একমাত্র ব্যতিক্রম ভাষা, যার লিপি আছে অথচ ভাষাটি হারিয়ে গেছে। এই নাগরী চর্চা ও গবেষণা হলে অনেক ইতিহাস ঐতিহ্যের সন্ধান পাওয়া যাবে। এমনটাই মনে করেন, সিলেটের নাগরী ভাষার গবেষক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আশ্রাফুল করিম।

বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও রচনা থেকে জানা যায়, হজরত শাহজালালের সঙ্গে ৩৬০ জন আউলিয়া সিলেটে আসেন। তাঁরা মূলত বিভিন্ন দেশ ও এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে আসেন। তাদের ভাষা বাংলা ছিল না। তখন একটি ভাষার চর্চা শুরু হয়, যা নাগরী ভাষা নামে পরিচিতি লাভ করে। এর ব্যাপ্তি ছিল আসামের করিমগঞ্জ  থেকে সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত।

তবে অনেকেই ভুল করে নাগরী ভাষাকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা ও বাংলা ভাষার একটি উপভাষা বলে মনে করে থাকেন।

এ ক্ষেত্রে ড. আশ্রাফুল করিম বলেন, “নাগরী আঞ্চলিক ভাষা ও বাংলা ভাষার একটি উপভাষা নয়। একটি স্বতন্ত্র ভাষা; যার লিপি আছে। রয়েছে আলাদা ব্যাকরণ। ”

এর বিজ্ঞানসম্মত লিপিমালা রীতিমতো বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করেন এই অধ্যাপক। কারণ আধুনিককালের ভাষাবিদরা ভাষাকে সহজ করতে যে পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করছেন প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ বছর আগে নাগরী লিপিতে তা করা হয়েছিল।

তিনি আরও জানান, ভাষাটি এতই সহজ যে, নারীরা মাত্র আড়াই দিনে শিখতে পারতেন। আর পুরষদের শিখতে লাগতো মাত্র একদিন। নারীরা গৃহস্থালির কাজকর্মের কারণে সময় কম পেতেন। তাই, আড়াইদিন, আর পুরুষরা গৃহস্থালির কাজ না থাকায় একদিনেই শিখে নিতেন।

জানা গেছে, এ ভাষার প্রচলন শুধু সিলেটেই সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ের বহু সংখ্যক লোকের মাতৃভাষা সিলেটি। এটি একটি প্রাচীন ভাষা।

ভাষাটির উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে ড. আশ্রাফুল করিম বলেন, “ইসলাম প্রচারের জন্য এখানে ৩৬০ আউলিয়া নিয়ে হযরত শাহজালাল আসার পর ভাষাটি শুরু হয়। তখন হিন্দুরা সংস্কৃত আর মুসলমানরা আরবির প্রতি অনুরক্ত থাকায় তাদের একই ভাষায় নিয়ে আসতে এই ৩৬০ আউলিয়ার মধ্য থেকে একটি কমিটি করা হয়েছিল, যারা হিন্দু-মুসলমান সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি লিপি বের করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল সবার মধ্যে ইসলাম প্রচার। ”

তিনি আরও বলেন, “সহজে শেখা যায় বলে ভাষাটি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ”

এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, “নাগরী ভাষার বর্ণগুলো আমাদের সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক গৃহস্থালি দ্রব্যের মতো হওয়ায় এটি শেখা ছিল সহজ। যেমন- লাঙ্গলের অনুরূপ বর্ণ আছে নাগরীতে। ’’

লন্ডনে সাম্প্রতিককালে ভাষাটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চর্চার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। সেখানে আরও চালু করা হয়েছে নাগরী লিপির ফন্ট।

ড. আশ্রাফুলের মতে, “ভাষাটি চর্চা ও গবেষণা হলে অনাবিষ্কৃত অনেক পুঁথি উদ্ধার সম্ভব; যার মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য নতুন করে বিনির্মাণ হবে। ”

বিভিন্ন গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ থেকে জানা গেছে, হালের অসংখ্য জনপ্রিয় গান রয়েছে, যেগুলো নাগরী লিপিতে লেখা হয়েছিল। যেমন- সৈয়দ শাহনূরের (১৭৩০-১৮৫৫) ‘অরিন জংগলার মাঝে বানাইলাম ঘর/ভাই নাই, বান্ধব নাই, কে লইব খবর’ কিংবা শিতালং শাহের (১৮০০-১৮৮৯) ‘অজ্ঞান মন, খুয়াইলায় মহাজনের ধন’ ইত্যাদি।

‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এই ভাষার বর্ণ সহজে শেখা যেতো। সিলেটের নাগরী বর্ণমালায় বর্ণসংখ্যা ৩২টি। বর্ণগুলো হচ্ছে- আ ই উ এ ও ক খ গ ঘ চ ছ জ ঝ ট ঠ ড ঢ ত থ দ ধ ন প ফ ব ভ ম র ল ড় শ হ।

নাগরী ভাষার আরেক গবেষক ড. মোহাম্মদ সাদিক তার ‘সিলেটের নাগরী: ফকিরি ধারার ফসল’ গ্রন্থে ৩৩টি বর্ণের কথা বলেছেন।

এ নাগরী বর্ণমালায় দুষ্প্রাপ্য ১৫টি পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনী সংস্থা উৎস প্রকাশন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কেতাব হালতুননবী’, ‘কড়িনামা’, ‘চন্দরমুখী’, ‘সোনাভানের পুঁথি’, ‘মহব্বতনামা’ ইত্যাদি।

গবেষকদের মতে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সিলেটি ভাষাকে স্বীকৃতি না দিলে এবং এর প্রচলন না ঘটালে একসময় প্রাচীন এ ভাষাটি হারিয়ে যাবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার তালিকা থেকেও ছিটকে পড়তে পারে ভাষাটি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৩
এসএ/ সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

শিল্প-সাহিত্য এর সর্বশেষ

welcome-ad